গ্রামীণ নারীদের সচেতনতায় অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন পিংকি আক্তার
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত যত ধরনের সাংসারিক কাজ আছে সব নারীদের করতে হয়। পরিবারের সকলের চাহিদা পূরণ, সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, ধান তোলার যাবতীয় কাজসহ সব কিছু। আমাদের গ্রামীণ সমাজের নারীরা সংসারের কাজ ছাড়াও বাড়িতে থেকে অর্থ উপার্জনের সাথেও যুক্ত থাকেন। যেমন কুটির শিল্পের কাজ, সেলাই করা, সবজি চাষ, প্রাণি সম্পদ পালন ইত্যাদি। যারা একটু লেখাপড়া জানেন তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করেন। যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, সেবিকা।
করোনা মুহূর্ত শুরু হওয়ার পর থেকে আমাদের দেশের সবাই নিজেদেরকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছেন। কিন্তু এই সময়ে এমন কেউ আছেন যারা ঘরে না থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে করোনা বিষয়ে সচেতন করে তোলার কাজ করে যাচ্ছেন।
লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের সানকিউড়া গ্রামের পিংকি আক্তার। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে আসছেন। আমাদের দেশে যখন প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়, এর কয়েকদিন পরেই তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। বাড়ি ফিরে শুরু হয় সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজ।
পিংকি আক্তার বারসিক’র সহযোগিতায় গড়ে উঠা লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়ন নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য। এছাড়াও তিনি বারসিক’র সাথে যুক্ত বিভিন্ন নারী ও কিশোরী সংগঠনে বয়োঃসন্ধিকালীন পরিচর্যা ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালায় আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। গ্রাম পর্যায়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আলোচনা, আলোচনা সভা এসবের মাধ্যমে তিনি করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে সকলকে পরামর্শ প্রদান করে যাচ্ছেন।
তিনি করোনা পরিস্থিতি শুরু হবার পর নিজ গ্রামের যুবকদের সাথে নিয়ে গ্রামটিকে পুরোপুরিভাবে লকডাউন করে রেখেছেন। প্রতিটি বাড়ির চারপাশে বাঁশের সাহায্যে বেড়া দেওয়ার জন্য গ্রামবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেন। এছাড়া প্রতি বাড়িতে ঢোকার সময় পানি ও সাবান রাখার পরামর্শ দেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার এভাবে নিয়ম মেনে চলছেন। তাছাড়া প্রায় চার মাস যাবৎ গ্রামে বাইরে থেকে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সাধারণ ছুটি শুরু হবার পর যারা বাড়িতে এসেছিলেন তাদের প্রত্যেককে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বাধ্য করা হয়।
গ্রামের দরিদ্র পরিবারের তালিকা তৈরি করে ইউপি সদস্য’র সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রণোদনা পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন এই পিংকি আক্তার।
সারাদিন অন্যের প্রয়োজনে তাকে বাড়ির বাইরে কাটাতে হয়। সে কারণেই তিনি খুব সকালে উঠে সারাদিনের যাবতীয় কাজ শেষ করেন। তারপর বেড়িয়ে পড়েন। নিজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। সেখানে গিয়ে করোনা বিষয়ক সচেতনতার পাশাপাশি এই সময়ে কিশোরীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা, নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য, নবজাতকের পরিচর্যার বিষয়েও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বর্তমান সময়ে যেহেতু ডাক্তার বা হাসপাতালে যাওয়া নিরাপদ নয়, তাই তিনি নিজে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ঔষধ সংগ্রহ করে রোগীদের বাড়িতে পৌঁছে দেন।
নারীদের যেহেতু বাড়িতে থেকে সব ধরণের কাজ করতে হয় তাই তিনি নারীদের সাথেই সচেতনতামূলক আলোচনা করেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে, নিজের ও পরিবারের সকলের সুস্থ থাকার বিষয়ে করণীয় কি, এই সময়ে কি ধরণের খাবার খেতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া নারীদের মনোবল বাড়াতে বিভিন্ন ধরণের আলোচনা করছেন।
লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি গ্রামে তিনি যোগাযোগ রাখছেন। প্রতিদিন ৮-১০টি বাড়িতে গিয়ে নারীদের সাথে আলোচনা করেন। অনেকে আবার সমস্যায় পড়লে তার সাথে যোগাযোগ করে সমাধানের চেষ্টা করেন। তিনি মোবাইলের মাধ্যমেও সচেতনতামূলক পরামর্শ প্রদান করেন।
তার প্রতিদিনের চেষ্টা আর পরিশ্রমে গ্রামীণ নারীরা নিজেদের মনোবল ধরে রাখতে পেরেছেন। কারণ এই সময়ে ভয় পেলে বা মনোবল হারালে অনেকেই ক্ষতির সন্মুখীন হতে পারেন। যে কারণে তিনি সকলকে দৃঢ় মনোবলে করোনা মোকাবেলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
গ্রামের নারীরা বর্তমান সময়ে নানা ধরণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করলেও নিজের পরিবার ও নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে চলেছেন। সুস্থ থাকার জন্য সকল ধরণের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। পিংকি আক্তার নিজের পরিবারের পাশাপাশি অনেক পরিবারের নারীদের সুস্থ থাকার সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। যে কারণে এই করোনাকালীন সময়েও নারীরা সুস্থ আছেন এবং সাংসারিক কাজ করছেন।
পিংকি আক্তারের এই সেবামূলক কাজ এলাকায় প্রশংসিত হয়েছে। তার অুনপ্রেরণায় অনেকে সচেতন হয়েছেন। পিংকি আক্তারের মতো আরও অনেকে এগিয়ে আসুক মানবতার সেটাই আমাদের সবার কাম্য।