স্বপ্নবাজ বায়েজীদ ও তার ভ্রাম্যমান অনলাইন সেবা
সাতক্ষীরা থেকে বাহলুল করিম।।
প্রতিবন্ধীরা সমাজের প্রতিটি স্তরেই অবহেলিত। কোনভাবেই তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। নানা প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে চলতে হয় তাদের। প্রতিবন্ধীদের বোঝা মনে করেন সবাই। তাদেরকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার নজরে দেখে মানুষ। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েই প্রতিনিয়ত সমাজ গঠনমূলক কাজ করে যাচ্ছেন অসংখ্য প্রতিবন্ধী। তেমনই একজন সাতক্ষীরার মো. বায়েজীদ হাসান।
তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। বর্তমানে সদর উপজেলার কামালনগরে বসবাস করেন। পরিবারের সদস্য সাতজন। বাবা, মা ও দুই ভাই, স্ত্রী ও এক ছেলে সন্তান নিয়েই তার সংসার। পরিবারের বড় ছেলে তিনি। ২০১০ সালে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পারিবারিক জীবনে একটি ছেলে সন্তানের বাবা হন তিনি। তার পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামে। ১৯৭৯ সালে দুই পা বাঁকা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। দুই পায়ের গোড়ালি ধনুকের মতো বাঁকা। ৮ বার অপারেশন করার পরও পা-দুটি সোজা হয়নি তার। সেজন্য ঠিকভাবে চলাচল করতে পারেন না তিনি। দুটি ক্রেস তার একমাত্র চলাচলের হাতিয়ার। তারপরেও নিজেকে কখনো প্রতিবন্ধী মনে করেন না।
ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। সাতক্ষীরায় আসেন ১৯৯০ সালের দিকে। ভর্তি হন সুলতানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। পঞ্চম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে সদর উপজেলার পি.এন. মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মা তাকে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন ও নিয়ে আসতেন। এভাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আনা-নেওয়া করেন। পরবর্তীতে বন্ধুদের সহযোগিতায় বাকি দু’টি বছর অতিবাহিত করেন। তিনি এভাবে স্কুল জীবনের দীর্ঘ পাঁচটি বছর নানা প্রতিকূলতার মাঝে কাটান। ১৯৯৭ সালে মানবিক বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে তিনি সাতক্ষীরা দিবা ও নৈশ কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০০০ সালে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর সাতক্ষীরা সরকারী কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বংলা বিভাগে থেকে ২০০৫ সালে তৃতীয় বিভাগে বি.এ. (অনার্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। খুলনার সরকারী বি.এল. কলেজ থেকে ২০০৬ সালে বাংলায় দ্বিতীয় বিভাগে এম. এ. (মাস্টার্স) পাশ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট অর্জন করার পিছনে তার মায়ের অবদান অনেক।
শিক্ষাজীবন শেষে চিন্তা করলেন কী করা যায়? বেছে নিলেন কম্পিউটারের কাজ। নিজে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৮ সালে প্রথম দোকান নেন সাতক্ষীরা নিউ মার্কেট সংলগ্ন আলী মার্কেটের দোতলায়। এখানে অনলাইনের বিভিন্ন সেবা দিতেন সাধারণ মানুষকে। দীর্ঘ ছয়টি বছর পার করেন এই দোকানে। শখের বশে ২০১০ সালে তিনি ১৮ জন প্রতিবন্ধীকে ফ্রি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেন। এর মধ্যে দুই জন বর্তমানে চাকরিও করছেন। সমাজের দশজন মানুষের মতো তিনি চলতে পারেন না কিন্তু চালাতে পারেন। ২০১৪ সালে সাতক্ষীরা নিউমার্কেটের সামনে থেকে মটরচালিত ভ্যানে পথচারীদের কম্পিউটারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের অনলাইন সেবা প্রদান করে থাকেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই সেবা। এই ভিন্নধর্মী কাজের জন্য বিভিন্ন সময়ে অবহেলিত হন। কথা শুনতে হয় অনেকের।
তার এই সেবা যেমন অনন্য। তেমনি এটি পরিবেশবান্ধবও। ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতিগুলো চালানোর জন্য ব্যবহার করেন সৌর শক্তি। তাই নেই বিদ্যুৎ বিম্ভ্রাটের ঝামেলাও। বর্তমানে তার এই ভিন্নধর্মী কাজটি নজর কেড়েছে অনেকের। প্রতিদিন ২০-২৫ জনের মতো মানুষ আসে সেবা নিতে। পথচারী এসে ভিড় জমায় এখানে। অনেকে আসেন দেখতে। অনেকে আসে সেবা নিতে। এই সেবা প্রদান করেই মাসে ৮ হাজার টাকার মতো আয় করেন। যা আয় হয় তা দিয়েই কোন মতে চলে তার সংসার। পরমুখাপেক্ষী না হয়ে নিজে সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বর্তমানে এখানে দুই জন ছাত্রী প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
প্রশিক্ষণ নিতে আসা মুনজিতপুরের বাসিন্দা সাদিয়া মাহবুব বলেন, “প্রায় একমাস যাবৎ এখানে আসি। কারিগরি বোর্ড থেকে ৬ মাস মেয়াদী কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কিন্তু কম্পিউটারের সব বিষয় ঠিকঠাক শিখতে পারিনি। তাই বাইজিদ ভাইয়ের কাছে আসা। তিনি আমাকে আন্তরিকতার সাথে কম্পিউটারের সকল বিষয়ে শেখানোর চেষ্টা করেন। বারবার কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেও বিরক্ত হন না। একজন অবিভাবকের মতো আমাকে কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষন দেন। আমি এখান থেকে Ms-Word, Ms-Excel, Mailing, Scanning, E-Mail, CV তৈরি করা ভালোভাবে শিখেছি।” সেবা নিতে আসা বাঁকালের বাসিন্দা অনুপ সরকার জানা তিনি ৮-১০ বারের মতো এখানে এসেছেন। এতো জায়গা থাকতে এখানে আসেন কেন? প্রশ্নের জবাবে বলেন, “বাইজিদ ভাইয়ের ব্যবহার ভালো সেজন্য এখানে আসা। অনেক আন্তরিকতার সাথে আমার কাজগুলো করে দেয়। আমি সব সময় অনলাইন চাকরির আবেদন করার জন্য এখানে আসি।”
২০১৭ সালের ১৪ মার্চ শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জে ইত্যাদির প্রোগাম অনুষ্ঠিত হলে এর পরিচালক হানিফ সংকেতের সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেদিন তিনি দেখা করতে পারেননি। দেখা হলো পরের দিন। তখন হানিফ সংকেত ক্যামেরা পাঠিয়ে তার একটি ভিডিও ফুটেজ তৈরি করেন। তাকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ত্রৈমাসিক প্রোগাম ‘ইত্যাদিতে’ একটি প্রতিবেদন দেন। ইত্যাদির পরিচালক তার এই ভ্রাম্যমান অনলাইন সেবার প্রশংসা করেন।
সমাজের অবহেলিত ও শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের আধুনিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বাসে অনেকগুলো কম্পিউটার নিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রত্যাশা তার। প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে বিদ্যুৎ নেই সেখানেই এই সেবা পৌঁছে দিতে চান। তিনি সর্বত্র ভ্রাম্যমান অনলাইন সেবা দেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বোঝা না হয়ে তিনি সমাজ গঠনমূলক কাজ করে দেশ ও দেশের মানুষকে বদলে দিতে চান। সমাজে সবার অধিকার সমান এটার বাস্তবায়ন করতে চান। সমাজে তার মতো মানুষ খুব কমই আছে।