এক মনসুর আলীর ঘুড়ে দাঁড়ানোর গল্প
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
তিন ছেলে এক মেয়ে মনসুর আলীর। স্ত্রীসহ ৬ জনের সংসার। বছর চারেক আগের কথা। ছেলে মেয়েরা স্কুলে বিভিন্ন ক্লাসে পড়ে। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ, খাওয়া দাওয়া, চিকিৎসা, নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিষের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন পাবনার চাটমোহরের মূলগ্রাম ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের মৃত এসকেন প্রাং এর ছেলে মনসুর আলী (৫২)। সংসার পরিচালনা করতে বেসরকারি সংস্থা থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি সময়ে মেয়ের বিয়ের জন্য আরো প্রায় ৬০ হাজার টাকা সূদে গ্রহণ করেন এলাকার সূদে কারবারীর নিকট থেকে। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন।
বিয়ের পর বাকি টাকায় সংসারে সাময়িক কিছুটা স্বচ্ছলতা আসলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি বাবদ ১ হাজার ৫শ’ টাকা ও সূদে নেওয়া ৬০ হাজার টাকার সুদ বাবদ ১২শ’ টাকা মোট ২ হাজার ৭ টাকা দিতে হচ্ছিল তাকে। পাশাপশি সংসারের এসময় ৬ জনের ভরণ পোষণও করতে হচ্ছিল তাকে। ঋণের পরিমাণ কমছিল না। ঋণে জর্জরিত মনসুর আলী দুচোখে তখন কেবল অন্ধকার দেখছিলেন। এ থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় না দেখে কাউকে না জানিয়ে সপরিবারে পাড়ি জমান ঢাকায়। বড় ছেলে লালন একটা চাকুরি জোগাড় করে নেয়। পৃথক সংসার তার। অন্য ছেলেরা তখনও বেকার। কেউই লেখাপড়ায় খুব একটা এগুতে পারেনি। তেমন কাজ না পেয়ে সেখানেও সুবিধা করতে না পেরে কিছুদিন পর ফিরে আসেন নিজ এলাকায়।
জীবন জীবিকার তাগিদে ছোট ভাঙ্গাচোরা একটি চায়ের দোকান করেন। সন্ধ্যা বেলা দোকানটি ভালো চললেও সারাদিন তেমন একটা বেচাকেনা হয় না। এমন সময় বছর খানেক আগে মাথায় নতুন চিন্তা আসে তার। শিখে নেন মনোলোভা হরেক রঙের খেলনা ছাতা তৈরির কাজ। শিশুরা আকৃষ্ট হয়ে কিনেন তার খেলানা ছাতা। শৌখিন মানুষেরাও শোপিস হিসেবে কিনেন তার তৈরি খেলনা ছাতা। বিভিন্ন শহরে ও চাটমোহর-ঢাকা রুটের বিভিন্ন ট্রেনে তিনি বিক্রি করতে থাকেন এ ছাতা। একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে থাকেন তিনি। স্ত্রী লাইলী ও ছোট ছেলে শান্ত তাকে এ কাজে সহায়তা করেন। ঋণ ও সুদের টাকা প্রায় শোধ করে ফেলেছেন। এখন তৃপ্তির হাসির ঝিলিক তাঁর চোখে মুখে।
মনসুর আলী বলেন, “এক সময় ভেবেছিলাম ঘুড়ে দাঁড়াতে পারব না। খেলনা ছাতা তৈরি ও বিক্রি শুরু করার পর থেকে যেন আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। জিআই তার কিনে ছোট ছোট করে কেটে তা পিটিয়ে সোজা করি। এগুলো দিয়ে তৈরি করি ছাতার ফ্রেম। তার পর বিভিন্ন রঙ এর উল দিয়ে এ ফ্রেমে ছাউনি দেই। জিআই তারের তীক্ষœ মাথায় পুতি আটকে দেই। প্রতিটা ছাতা তৈরিতে ৫ থেকে ৬ টাকা খরচ পরে। পাইকারী ১৫ টাকা পিস বিক্রি করি। আর খুচরা ২০ থেকে ৪০ টাকা বিক্রি করি। যার কাছে যেমন নিতে পারি নিই।” তিনি আরও বলেন, “পাবনা শহরের বড় বাজার থেকে ৩শ’ টাকা কেজি দরে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, সাদা, নেভী ব্লু বিভিন্ন রঙের উল কিনি। স্ত্রীর সহায়তায় দুইজন এক দিনে ৪০টি ছাতা তৈরি করতে পারি। ছোট ছেলে ১২ বছরের শান্ত তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে আর পড়েনি। এখন সে আমাদের তৈরিকৃত ছাতা বিভিন্ন ট্রেনে বিক্রি করে। দুই ছেলে ও আমরা স্বামী স্ত্রী এ চারজনের সংসার এখন আমাদের। দৈনিক দুইশ টাকার মতো সংসার খরচ।” তিনি বলেন, “৪০টি ছাতা ২৫ টাকা করে বিক্রি করলে ও ১ হাজার টাকা হয়। খরচ বাদে ৭শ’ টাকার মতো লাভ থাকে। চায়ের দোকানে ৫ থেকে ৬শ’ টাকা বিক্রি হয়। সেখানেও ১শ’ থেকে ১শ’ ৫০ টাকার মতো লাভ থাকে। বর্তমানে সপ্তাহে ১ হাজার ৫শ’ টাকা ঋণের কিস্তি দিচ্ছি। ঋণ প্রায় শেষ। সব মিলিয়ে ভালো একটা অবস্থানে প্রায় চলে এসেছি।”
মনসুর আলীর স্ত্রী লাইলী বলেন, “তিন চার বছর আগে মেয়ের শিল্পীকে বিয়ে দেয়ার সময় ত্রিশ হাজার টাকা যৌতুক দেই। সেসময় সংসারের প্রয়োজনেও ঋণ তোলা হয়। অনেক ঋণী হয়ে পরেছিলাম। দিনে রাতে কাজ করে এসকল টাকা শোধ করে ফেলেছি প্রায়।”
কেবল মনসুর বা তার পরিবার নয় এ গ্রামের রবিউল, মোহাম্মদসহ আরো কয়েকজন খেলনা ছাতা তৈরি করাটাকেই জীবন জীবিকার উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কখনো কখনো ক্ষুদ্র হস্ত শিল্পজাত দ্রব্যও যে পাল্টে দিতে পারে জীবন মনসুর যেন তার অনন্য দৃষ্টান্ত।