সাম্প্রতিক পোস্ট

চর পাড়ার ধূসর সাদা সংগ্রামী সবুজ জীবন

চর পাড়ার ধূসর সাদা সংগ্রামী সবুজ জীবন

সাতক্ষীরা থেকে এস. এম. নাহিদ হাসান।। 

বাগডাঙ্গীর চর। এখানে প্রায় ৪০ ঘর মানুষের বাস। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর ইউনিয়নের বেতনা নদীর পাড়ের এলাকাটি বাগডাঙ্গীর চর নামে পরিচিত। নানা সমস্যার কারণে ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এই চরে এসেছে। চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সহযোগিতায় এখানে বসতি গড়ে তুলেছে। চরের মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে সংগ্রাম করে, রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে নিদারুণ কষ্টে বেঁচে আছে।

8

বসতভিটা না থাকা, দীর্ঘদিন বাড়ি পানিবন্ধী থাকা, স্বামীহারা সন্তান নিয়ে বিধবা প্রভৃতি কারণে নানা গ্রামের নানান মানুষের ঠাই হয়েছে এই চরে। পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি থাকায় পিতার জমি ভাগ করার পর ভিটা বাড়িটুকুও জোটেনি যাদের তারাও এসেছেন এখানে। সবাই নতুন একটি জীবনের স্বপ্ন দেখছেন।

সাতক্ষীরার মাছখোলা ব্রিজ সংলগ্ন বেতনা নদীর তীরে এ চর। যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানির অভাব তো রয়েছে। এ প্রসঙ্গে চরের বাসিন্দা আব্দুল হাই বলেন, “কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য কাদা ঠেলে নিতে হয় শহরের হাসপাতালে।” স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেন, “চরে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং রাস্তার উন্নয়ন করা হলে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।” পাশাপাশি রয়েছে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে এখানে জীবনযাপন করতে হয়। চরের মানুষের মাঝে বর্ষার সময় নেমে আসে মহাদুর্যোগ। দৈনন্দিন কাজে করতে যাওয়া তো দূরের কথা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাওয়ার মত অবস্থা থাকে না। তখন তাদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

2

প্রায় ৫ বছর ধরে এই চরে মানুষ বসবাস করছে। প্রকৃতি শিখিয়েছে কিভাবে সংগ্রাম করে জীবনযাপন করতে হয়। চরের মানুষদের কর্ম জীবন বড়ই বিচিত্র। কৃষি কাজ, ভ্যানচালক, অন্যের জমিতে কাজ, গ্রামের বড় (গৃহস্থ) বাড়িতে কামলা খেটে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের। কারো আবার সংসার চলে বেতনা নদীতে মাছ ধরে। তারপরও চরে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। চরের মানুষদের কর্মজীবন বিচিত্র হলেও একটি দৃশ্য সবার চোখে ধরা পড়বে। প্রতিটি বাড়ির আঙিনা যেন ছোট্ট সবুজ মাঠ। প্রয়োজনের তাগিদে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে বাড়িতে সবজি বাগান তৈরি করেছে।

1

চরের অধিকংশ বাড়ির আঙিনায় দেখা মিলবে সবুজ তরতাজা শাক-সবজি। যেমন লাউ, বেগুন, পালংশাক, মুলা, কাচা ঝাল, লালশাক, ধনেপাতা, টমেটো, বিটকপি, পেঁয়াজ, ফুলকপি, মিষ্টি কুমড়া, ওলকপি, সিম। এছাড়া প্রতিটা বাড়ির সামনে আছে একটি করে পুকুর বা ডোবা। এসব পুকুর বা ডোবায় তেলাপিয়া, রুই, খরকুনুসহ কার্প জাতীয় মাছ ও সবজি পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করছে।

সবজি চাষের জন্য শীতকাল বেশ উপযোগি। গরমের সময় মাটিতে নোনা ধরে। দুই একটি সবজি ছাড়া অন্যকিছু লাগানো সম্ভব হয় না। দুই একবার বৃষ্টি হলে মাটির নোনা কেটে যায়। তখন চরে সবজি চাষের ধুম পড়ে। বৃষ্টির আগ পর্যন্ত পুকুর, ডোবা বা নলকুপের পানি দিয়ে বাগানের সেচ কাজ চালানো হয়। গৃহিণী ফতেমা বেগম বলেন, “বর্ষায় রাস্তায় এত কাদা হয় বাজার করতে যাওয়া যায় না। তাই যার যেখানে জায়গা আছে সেখানে সবজি বাগান করি। এখন সারাবছর সবজি বাড়িতে হয়। ডোবায় মাছ আর বাড়ির সবজি দিয়ে খাওয়া ও দাওয়াও চলে।”

3

উৎপাদিত সবজি পারিবারিক পুষ্টি চাহিদায় ভূমিকা রাখছে। নিজেদের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত শাক-সবজি হাট-বাজারে বিক্রি করে অার্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হচ্ছেন এই চরের বাসিন্দারা। আগামী মৌসুমে চাষাবাদের জন্য অনেকেই ফসলের বীজ সংরক্ষণ করেন। অনেকে গোবিন্দপুর, ব্রক্ষ্মরাজপুর, সাতক্ষীরা বড় বাজার থেকে ফসলের বীজ, চারা সংগ্রহ করে চাষাবাদ করেন।

বাড়ির নারীরা বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে বাড়িতে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন করছেন। গরু ছাগলের বিষ্ঠা সবজি বাগানের সারের কাজ করে। পুরুষের পাশাপাশি গৃহিনীরাও সবজি বাগান পরিচর্যা করে। বাড়ির সামনে সবজি বাগান, ঘরের চালে লাউ কুমড়া গাছ, পুকুরে মাছ এসব দৃশ্য দেখলে কার না প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

কিন্তু খুব সহজে সবজি বাগান করা সম্ভব হয়নি। সেখানেও এসেছে বাধা বিপত্তি। পানির জন্য বাগান করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। সে অসম্ভবকেও তারা সম্ভব করেছে। পুকুরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ঐ পানি সবজি বাগানে কাজে লাগিয়েছে। অনেকে বাড়িতে নলকুপ বসিয়েছে। চরের বাসিন্দা আব্দুল মজিদ বলেন, “৩-৪ বছর ধরে চরে বাস করছি। শুরু থেকেই সবজি বাগান করছি। প্রথমে পানির খুব কষ্ট ছিলো, ডোবায় বর্ষার পানি ধরে রাখতাম। ঐ পানি চাষের কাজে ব্যবহার করতাম। এখন নলকূপ বসিয়েছি। পানির কষ্ট নেই। সারাবছরই চাষ করি। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাকিটা হাটে বিক্রি করি।”

7

ইসলাম ঢালী বলেন, “পাঁচ বছর পরিবার নিয়ে বাস করছি। পেপে, লাউ, ঝাল, আলু, টমেটোসহ বিভিন্ন তরকারি চাষ করি। দুটি গরুও আছে। বাগানে গরুর বিষ্ঠা সার হিসাবে ব্যবহার করি। নলকূপের পানি দিয়ে চাষাবাদ বেশ ভালোই চলছে।”

এভাবেই চলে যাচ্ছে শহর থেকে দূরে কোলাহল মুক্ত বাগডাঙ্গীর চর পাড়ার মানুষদের ধূসর মাঠা সংগ্রামী জীবন।

happy wheels 2

Comments