সাতক্ষীরার পুষ্টি পরিস্থিতি-১: কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু
:: সাতক্ষীরা থেকে শেখ তানজির আহমেদ
“এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। বাচ্চাটার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ওর মাও ভালো নেই। ডাক্তার বলছেন, আরো কয়েকদিন হাসপাতালে থাকা লাগবে।”- সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে স্ত্রীর পাশে বসে এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বৈকারী গ্রামের জয়নাল আবেদিন। তার স্ত্রী রাশিদা খাতুন সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে একটি ফুটফুটে বাচ্চা প্রসব করেছেন। কিন্তু কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করায় তারা সন্তানের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বেশ চিন্তিত।
জয়নাল আবেদিন জানান, তার বাচ্চার ওজন মাত্র এক কেজি ৩শ গ্রাম। বাচ্চাটা চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না। পাশে দাড়িয়ে থাকা সেবিকা জানালেন, রাশিদা খাতুনের বয়স মাত্র ১৬ বছর। বাচ্চা প্রসব করেছেন গর্ভধারণের মাত্র ৮ মাস পর। তার প্রজনন নালী অপুষ্ট ছিল। এছাড়া মা-শিশু দুজনেই অপুষ্টির শিকার। দেখছেন না, মাও কেমন লিকলিকে? বাচ্চাটার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই বললেই চলে।
রাশিদা খাতুনের পাশের বেডেই রয়েছেন রাশেদা নামে আরো এক মা। তার সন্তানও কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। তার উপর আবার নিজের বুকে দুধ নেই বলে এক মাস বয়সী বাচ্চাকে গরুর দুধ খাইয়েছিলেন। জটিলতা বেঁধেছে সেখানেই। নিজ বাড়িতেই বাচ্চা প্রসব করলেও এখন তার ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে।
এভাবেই পুষ্টিহীনতার কারণে কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু। একই সাথে বাড়ছে কৃশকায় (লিকলিকে) শিশুর সংখ্যাও।
শিশু বিশেষজ্ঞ শামসুর রহমান বলেন, মায়ের অপুষ্টি শিশুর অপুষ্টির জন্য প্রাথমিকভাবে দায়ি থাকে। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে না পারলে শিশু অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আবার জন্মের পর ২৪ মাস পর্যন্ত মা ও শিশুর অপর্যাপ্ত যত্ন এবং শিশুকে খাওয়ানোর সঠিক নিয়ম না জানা ও সুষম খাদ্য না খাওয়ানোর কারণেও শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়।
সাতক্ষীরার পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জেলা সমন্বয় সভায় বলা হয়, মূলত অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা ও পরিবেশ, কম বয়সে গর্ভধারণ, বাল্য বিবাহ ও ঘন ঘন গর্ভধারণ, মায়ের স্বল্প ওজন, পরিবারে খাদ্যের অসম বণ্টন, বহু বিবাহ, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাতক্ষীরায় বিদ্যমান অপুষ্টির কারণ।
আর এর প্রভাবে অসুখ, প্রতিবন্ধীতা, মৃত্যু, বুদ্ধির স্বল্পতা, কম উৎপাদনশীলতা, বুদ্ধি বিকাশ ও শারীরিক গঠনে যেমন সমস্যা বাড়ছে, তেমনি শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও যাচ্ছে কমে।
তবে, সাতক্ষীরার পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সাতক্ষীরায় বেড়েছে জন্মের প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো হার। একই সাথে বেড়েছে শারীরিক গঠনে প্রয়োজনীয় আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণের হারও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের সর্বশেষ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)-তে বলা হয়েছে, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে সাতক্ষীরার ২৯.৫ শতাংশ শিশু। যেখানে সারাদেশে এ হার ২৬ শতাংশ। সাতক্ষীরার ১২.১ শতাংশ শিশু কৃশকায়। যেখানে সারাদেশে এ হার ৯.৬ শতাংশ। ৩৪ শতাংশ শিশু খর্বকায়। যেখানে সারাদেশে এ হার ৪২ শতাংশ।
শিশুর অপুষ্টি নির্ণয়ের অন্যান্য সূচকে সাতক্ষীরার অবস্থান মাঝামাঝি হলেও সার্বিক বিচারে তা সন্তোষজনক নয়।
সর্বশেষ প্রকাশিত এমআইসিএস বলছে, সাতক্ষীরায় বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশু রয়েছে ২৬ শতাংশ। সারাদেশে এ হার ৩১.৯ শতাংশ। জন্মের পরপরই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ৪৬.৬ শতাংশ। সারাদেশে এ হার ৫৭.৪ শতাংশ। এছাড়া আয়োডিন যুক্ত লবণ গ্রহণের হার ৫৯.৪ শতাংশ। সারাদেশে এ হার ৫৪.৩ শতাংশ।
অপরদিকে, বিডিএইচএস-২০১১ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুলনা অঞ্চলের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৫৪.২ শতাংশ রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে। আর ১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের ৩৭.৪ শতাংশ রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে।
তবে, আশার কথা হলো সাতক্ষীরার সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ইউনিসেফের নিউট্রিশন স্পেশালিস্ট ড. মুহাসীন আলী বলেন, সাতক্ষীরার পুষ্টি পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে অন্যান্য জেলার চেয়ে উদ্বেগজনক। এর কারণ উপকূলীয় জেলা বা উপজেলাগুলোতে লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতাসহ পরিবেশগত বিপর্যয় লেগেই থাকে। এসব কারণে খাদ্যে বৈচিত্র্য থাকে না বললেই চলে। একই অবস্থা ভোলা, খুলনার একাংশ, সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকাসহ অন্যান্য উপকূলীয় জেলায়ও। পানি ভালো না হওয়া এর অন্যতম কারণ। এজন্য স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ভঙ্গুর, যা অপুষ্টির অন্যতম কারণ।
সাতক্ষীরার সহকারী সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, অপুষ্টি জনশক্তি উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। অপুষ্টি দূরীকরণে জেলার প্রত্যেক উপজেলায় পুষ্টি কর্নার চালুসহ সরকারি-বেসরকারি দপ্তরসমূহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়ন একটি সমন্বিত বিষয়। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
তিনি বলেন, মা ও শিশুর পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে কিছু কিছু সূচক সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নত করা সম্ভব হয়েছে। অন্যান্যগুলোও সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে।