খাদ্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ নারী

সিলভানুস লামিন

এই বছরের (২০১৮) বিশ্বখাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ‘একটি ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠা’ করার কথা বলা হয়েছে। একটি ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্যের যোগান ও সমবণ্টন। শুধুমাত্র খাদ্যের যোগান বৃদ্ধি করলেই চলবে না; এ খাদ্যকে অবশ্যই হতে হবে পুষ্টিকর, ভেজালমুক্ত এবং মূল্যসাশ্রয়ী। পুষ্টিহীনতা ও ভেজালের কারণে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও বিশ্বের উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তাকে বিপন্ন ও ঝুঁকিযুক্ত করার খবর আমরা কমবেশি সবাই জানি। আধুনিক কৃষির নামে ‘কৃষি’কে কৃষকের কাছ থেকে ছিনতাই করার কারণে কৃষি এখন কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর মুনাফা করার খাত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বাণিজ্যিক কৃষির নাম দিয়ে উন্নত বীজ (!), সার ও বিষ ব্যবহারে কৃষিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু মানসম্মত ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনে ব্যর্থ হয়েছে এই আধুনিক কৃষি। উপরোন্তু খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বিষ ব্যবহারে মানবস্বাস্থ্য হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে এই আধুনিক কৃষি।

অন্যদিকে আধুনিক কৃষির আর্বিভাবে খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও খাদ্যমূল্য কখনও সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। খাদ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে দরিদ্র মানুষেরা তাদের উদরপূর্তির জন্য অপেক্ষাকৃত কম পুষ্টিকর ও স্বল্পমূল্যের খাদ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলশ্রুতিতে তারা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এবং পুষ্টিহীনতার কারণে তাদের কর্মক্ষমতা হ্রাস হচ্ছে, কমে যাচ্ছে তাদের উৎপাদনশীলতাও, যা তাদেরকে ক্রমান্বয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর করে তুলেছে। খাদ্যের পেছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করার অর্থ হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অপেক্ষাকৃত কম অর্থ বিনিয়োগ করা। এর পরিণতি কী? দরিদ্র মানুষের শিক্ষার হার হ্রাস পাবে। শিক্ষার হার কমে যাওয়ার কারণে তারা দিনকে দিন দরিদ্রতর হবে এবং নানান কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবে, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা লাভের মানসিকতা তাদের ভেতরে তৈরি হবে না ইত্যাদি। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১০-১১ অর্থবছরেই খাদ্যদ্রব্যের মূল্য উর্ধ্বগতির জন্য বিশ্বে নতুন করে আরও ৭০ মিলিয়ন মানুষ চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকায় যুক্ত হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এসব চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীদের সংখ্যাই বেশি, যারা গ্রামে বাস করেন।

আমরা জানি, গ্রামীণ নারীকে জীবনের প্রতিটি পদেই বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ নারীরা একাধারে কৃষাণী, জেলে, পশুপালক, উদ্যোক্তা, লোকায়ত জ্ঞানের ধারক, বাহক এবং সংরক্ষক। কৃষির সামগ্রিক উন্নয়ন, পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনায় গ্রামীণ নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন সেই দীর্ঘকাল থেকে। পরিবেশবান্ধব স্থায়িত্বশীল কৃষিব্যবস্থা অনুশীলনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারী বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, বিশ্বে ৬০৮ মিলিয়ন পুরুষের পাশাপাশি ৪২৮ মিলিয়ন নারী কৃষিক্ষেত্রে কাজ করে সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত।

আমরা যদি মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো যে, নারীর হাত ধরে কৃষির আর্বিভাব ঘটেছে। বৈচিত্র্যময় শস্য-ফসল আবাদের মাধ্যমে নারীরা কৃষিক্ষেত্রে শুধু বৈচিত্র্যই নিয়ে আসেনি বরং মানুষের স্বয়ংসম্পূর্ণ খাদ্যব্যবস্থারও সূচনা করেছেন। শুধু কি তাই? গ্রামীণ নারীরা বীজ সংরক্ষণ করে, ফসল ঘরে আনার পর হাড়খাটুনি পরিশ্রম করে সেই ফসলগুলো প্রক্রিয়াকরণ করেন। অন্যদিকে কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কৃষি উপকরণ আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমাজে আত্মীয়তা ও সম্প্রীতির বন্ধন রচনাতে সহায়তা করেন, যার সার্বিক ফলাফল হচ্ছে কৃষির সামগ্রিক উন্নয়ন। বস্তুত বিশ্বের কমবেশি প্রায় প্রতিটি দেশেই গ্রামীণ নারীরা খাদ্য উৎপাদন, বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিনিময়, পশু পালন ও পরিচর্যা, পরিবারের জন্য খাদ্য, পানীয় ও জ্বালানী যোগান দেওয়া, গৃহস্থালীর বিভিন্ন কাজ সম্পাদন এবং সন্তান ও বয়স্ক ব্যক্তিদের যত্ন ও দেখভালের মাধ্যমে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন। মূলত খাদ্য উৎপাদনসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গ্রামীণ নারীর অবদানের মূল্যকে বিবেচনা করেই বর্তমানে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর গ্রামীণ নারী দিবস এবং ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হয়!

তবে দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, কৃষি ও গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন, খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ দারিদ্র দূরীকরণে অসামান্য অবদান রাখার পরও আজ পযর্ন্ত কৃষিক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রামীণ নারীর অবদান স্বীকৃত নয়। কৃষক বললেই আমাদের চোখে যার ছবিটা ভাসে, সে হলো একজন পুরুষ! পুুরুষ কৃষক মাঠে কাজ করছেন, ফসল কাটছেন এই চিত্রটাই আমাদের চোখে ভাসে! অথচ এসব ফসলের বীজ সংগ্রহ,সারাবছরে সংরক্ষণ, মাঠের আগাছা দমন এমনকি মাঠ প্রস্তুতকরণ, ফসল সংগ্রহসহ অন্যান্য কৃষিসংশ্লিষ্ট কাজে নারীরাও যে সমান অংশগ্রহণ রয়েছে বিষয়টি আমরা বেমালুম ভুগে গেছি। অন্যদিকে দেখা যায়, গ্রামীণ দারিদ্রতার চাপে নারীকে তাই বহুমাত্রিক কর্ম সম্পাদন করতে হয়; বিশেষ করে আধুনিক কৃষির আগমনের পর থেকেই নারীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষিঅনুশীলন করতে পারছেন না; প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছে না বিধায় পরিবারের অর্থনীতির চাকাকে সচল করার জন্য সব ধরনে বাধানিষেধ উপেক্ষা বাইরে কাজ করতে যায়। কিন্তু কি দেখি সেখানে? শিক্ষার হার কম হওয়া, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না পাওয়া এবং পরিবারের পুরুষতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে নারীরা সে সুযোগও ঠিকমতো পাচ্ছে না।

এশিয়ার দেশগুলোতে ভূমি মালিকানা সামাজিক মর্যাদা এবং ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় তাই নারীকে ভূমি মালিকানা লাভ থেকে নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়। (IFAD) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গ্রামীণ নারীদের ভূমির মালিকানার হার ২%ও কম। ভূমির মালিকানায় অধিকারহীনতার কারণেই নারীরা অনেক সময় ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে যার প্রভাব পড়ে তাদের অর্থনৈতিক জীবনে। স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদের প্রথম ব্যবহারকারী এবং সংরক্ষক হিসেবে গ্রামীণ নারীর অবদান থাকলেও স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।

বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে যে, সন্তানের পুষ্টি ও শিক্ষাপ্রদান এবং ইতিবাচক উৎপাদনশীলতার জন্য নারীদের শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন। বলা হয়েছে, শিক্ষাই পারে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে। ভারতের এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী বলেছেন, “গ্রামীণ নারীকে যদি প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ করা হয় তাহলে পরিবারের সব সদস্যদের উপকার আসবে”। তবে আমরা কী দেখি? নারীরা এখনও নানান শিক্ষার বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শিক্ষিত না হওয়ার কারণে আধুনিক কৃষিব্যবস্থাই গ্রামীণ নারীরা যেমন চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে, তেমনি পরিবারের শিশুদের পুষ্টি যোগান ও শিক্ষাসেবা প্রদানে তারা সচেতন হতে পারেনি। উপরোন্তু অশিক্ষার কারণে তারা বিভিন্ন মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং বৈষম্যের সাথে আপোস করেই বেঁচে থাকে; অধস্তন মনস্তত্ব গড়ে উঠে তাদের ভেতরে যে, তারা পুরুষের অধীনস্থ। দেখা যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা নানান সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও মনস্তাত্তিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

বিশ্বে এখনও খাদ্য সঙ্কট বিরাজমান। তাই বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। ফাও’র (FAO, ২০১৮) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ৮২০ মিলিয়ন মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৭০ ভাগ দরিদ্র মানুষ গ্রামে বাস করেন যারা কৃষি, মৎস্য ও বনখাতের ওপর নির্ভরশীল। তাই একটি ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার করার জন্য প্রথমে প্রয়োজন খাদ্য সঙ্কটের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, উৎপাদিত খাদ্যের সুসমবণ্টন নিশ্চিত করা, কৃষিখাতে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, স্থায়িত্বশীল খাদ্য উৎপাদনে ছোট, মাঝারি ও বড় কৃষাণ ও কৃষাণীদের প্রশিক্ষণ, কৃষিখাতে তাঁদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্য উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় পুরুষের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের ভূমিকার স্বীকৃতি দেওয়া। খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কৃষাণ ও কৃষাণীদের ওপর কোন প্রযুক্তি চাপিয়ে না দিয়ে তাদের লোকায়ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য উৎপাদন করার সুযোগ দিতে হবে। এবং অবশ্যই কৃষিকে তাদের কাছে লাভবান খাত হিসেবে সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই আমরা একটি ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে পারবো।

happy wheels 2

Comments