শীতবস্ত্র বিতরণ ও পাইকুড়া যুব সংগঠন
নেত্রকোণা থেকে শংকর ম্রং
বর্তমানে শীতকাল। বাংলাদেশের ৬টি ঋতুর মধ্যে শীতকাল অন্যতম। শীতকাল যেমন ছুটি, বেড়ানো, পিঠাপুলি, সবজির মৌসুম; তেমনি উষ্ণতা খোঁজার মৌসুম। তবে এই উষ্ণতা অন্বেষণ বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের জন্য বেশ কঠিন। আর তাই এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য শীতকাল প্রতিবছর আনন্দ এর চেয়ে বয়ে নিয়ে আসে কষ্টের বার্তা। শীতের সময় তাই তাদের জন্য মুখ্য হয়ে ওঠে গরম কাপড়; খাদ্য কিংবা অর্থের চেয়েও।
বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় শীতের প্রকোপ সমান নয়। কোথাও বেশি কোথাও তুলনামুলক কম। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে হিমালয় পর্বতের নিকটবর্তী জেলাগুলো শীতের প্রকোপ বেশি। আর নেত্রকোণার জেলার দূর্গাপুরে স্বাভাবিকভাবে শীতের প্রকোপ বেশি পড়ে তুলনামুলকভাবে। তাই গত ৩ জানুুয়ারি ২০১৭ তারিখ নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়নের ১০৩ জন দরিদ্র ও অসহায় নারী-পুরুষ শীত বস্ত্র পেয়ে খুবই আনন্দিত।
শীতবস্ত্র বিতরণের এই মহতি উদ্যোগটি গ্রহণ করে পাইকুড়া যুব সংগঠন। এই উদ্যোগটি এলাকার দরিদ্র মানুষের জন্য সময় উপযোগী এবং অত্যাবশ্যকীয়। এ প্রসঙ্গে শীতবস্ত্রপ্রাপ্ত প্রবীণ লাকজান বেওয়া (১০২), ফুলবানু বেওয়া, আনোয়ারা বেওয়া, ইসলাম উদ্দিন ও আজিম উদ্দিন বলেন, “মেলা শীতে আমরার রাইতে মেলা কষ্ট অইতে ছিল। এই সময়ে যুব সংগঠন শীত বস্ত্র দিওন আমরার খুব উপকার অইছে। রাইতে শীতে অহন আরামে হুইতে পারবাম”। তারা যুব সংগঠনের সদস্যদের এমন উদ্যোগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পাইকুড়া যুব সংগঠন ২০১৫ সালের পহেলা এপ্রিল গঠিত হয়। গ্রামের বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় এই যুব সংগঠনটি। বর্তমানে এই সংগঠনের মোট সদস্য সংখ্যা ১০২ জন। সংগঠনের অধিকাংশ সদস্যই পেশায় ছাত্র, কৃষক, দিনমজুর ও অন্যান্য পেশার সাথে যুক্ত। সংগঠন গড়ে তোলার পর থেকে এই সংগঠন বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করে সেগুলো বাস্তবায়ন করে আসছে।
যুব সংগঠন এর এই শীতবস্ত্র বিতরণ কোন ত্রাণ কার্যক্রম নয়। কিংবা নয় কোন সংবাদপত্রের ছবিতে স্থান পাওয়ার জন্য। বরঞ্চ এলাকার এবং সময়ের চাহিদাতেই নেয়া হয়েছে উদ্যোগটি। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এলাকার উন্নয়নে বৈচিত্র্যময় উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। উদাহরণ হিসেবে তারা ২০১৬ সালে সংগঠনের উদ্যোগে এলাকার জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কৃতি শিক্ষার্থীদেরকে সংবর্ধনা প্রদান করেছে। এলাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব মোকাবেলার জন্য ১৬টি জাত নিয়ে এলাকা উপযোগি ধানের জাত বাছাই গবেষণা শুরু করেছে। এছাড়াও সামাজিক সমস্যা এবং ব্যাধি নিয়েও সংগঠনটি স্বোচ্চার। প্রাশাসনের সহযোগিতায় মাদক ব্যবসা ও মাদক সেবন বন্ধকরণ, বাল্য বিবাহ বন্ধকরণ কিংবা প্রবীণ অধিকার রক্ষায় সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযান কার্যক্রমের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন উল্লেখযোগ্য।
এ পর্যন্ত যুব সংগঠনের সদস্যরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে এলাকার প্রভাবশালীদের মাদক (ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাজা) ব্যবসায়ীদের মাদক ব্যবসা বন্ধ করেছে এবং মাদকসেবী যুবকদের অনেককেই পরামর্শ দিয়ে সংশোধন করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও তারা প্রশাসনের সহযোগিতায় পঞ্চম শ্রেণীর এক নারী শিশু শিক্ষার্থীর বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
এই সংগঠনের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয় সদস্যদের চাঁদার টাকায়; কোন অনুদান কিংবা কোন সংস্থার আর্থিক সহযোগিতা নয়। নিজেদের সম্মিলিত অর্থ এবং আদম্য মনোবল নিয়ে নিজেদের এলাকার উন্নয়ন করাই তাদের স্বপ্ন। যুব সংগঠনটি পাইকুড়া গ্রামকে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর। সংগঠনটি তাদের উদ্যোগ বাস্তবায়নে এলাকাবাসীদের এবং বিভিন্ন ব্যক্তি এবং স্বেচ্ছাস্বেবী প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধি, পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে পাশে থাকার আহবান জানান।
নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়নর হাওর বেস্টিত ও সীমান্ত ঘেষা হওয়ায় উন্নয়নের ছোয়া থেকে অনেকটাই বঞ্চিত এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। বিশেষভাবে সরকারী সুযোগ-সুবিধা, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই বঞ্চিত। এহেন অবস্থায় পাইকুড়া যুব সংগঠনের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। এভাবে নেত্রকোণা অঞ্চলের সকল এলাকায় যুব সমাজ সংগঠিত হয়ে এলাকার ও জনগোষ্ঠীর সমস্যা চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানে উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে সরকার বা অন্য কারো মূখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হবেনা। এলাকার উন্নয়নও এতে স্থায়ীত্বশীল হবে। তবে যুব সংগঠনের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে এলাকার বিত্তশালী ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই যুব সমাজ উদ্যোগ গ্রহণে আরও উৎসাহী হবে। পাইকুড়া যুব সমাজের এই উদ্যোগ অন্যান্য এলাকার যুব সংগঠন ও যুব সমাজকেও এমন উদ্যোগ গ্রহণে প্রভাবিত করবে বলে আমারা আশাবাদী।