সাম্প্রতিক পোস্ট

বেতনায় ফিরে আসছে প্রাণ প্রবাহ ?

বেতনায় ফিরে আসছে প্রাণ প্রবাহ ?

:: সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম ::

ভূমিকা

বাংলাদেশ নদীমাতৃক। কিন্তু বাংলাদেশে কতগুলো নদী ছিল বা বর্তমানে কতগুলো নদী বহমান আছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও নেই। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কি.মি. আয়তনের বাংলাদেশের ২৩০টি নদীর ভেতর ৫৭টি প্রধান নদীর উৎস সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চল। তবে এশিয়াটিক সোসাইটি-বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, ছোট বড় মিলিয়ে ৭০০ নদী বাংলাদেশে জালের মতো বিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের নদীপ্রণালী এক জটিল জলসার্কিট তৈরি করেছে, যা দুনিয়ার অন্য কোনো নদীপ্রণালী দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। নদী যে অঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে তাকে নদীর উৎস এবং যে স্থানে সমুদ্রে বা হ্রদে মিলিত হয় সে স্থানকে মোহনা বলে। নদীর চলার পথে কখনও কখনও ছোট ছোট অন্যান্য নদী বা জলধারা এসে মিলিত হয়ে প্রবাহ দান করে-এগুলো উপনদী নামে পরিচিত। একটি নদী এবং এর উপনদীসমূহ একত্রে একটি নদীপ্রণালী বা নদীব্যবস্থা গঠন করে। একটি নদী কেবলমাত্র একটি জলধারা থেকেই সৃষ্টি হয় না। অসংখ্য ছোট ছোট জলধারা থেকেই একটি নদী নানান অঞ্চলে নানান নামে ও পরিচয়ে প্রবাহিত হয়।

বেতনা নদী সাতক্ষীরা শহরের প্রাণ

বাংলাদেশের উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলা গড়ে উঠেছে নদীকে ঘিরে। কপোতাক্ষ, বেতনা, খোলপেটুয়া, কাকশিয়ালী, মরিচ্চাপ, রায়মঙ্গল, মাদার জেলার প্রধান প্রধান নদী। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা শহর গড়ে উঠেছে বেতনা নদীর তীরে। একসময় বেতনা  প্রবাল প্রবাহমান ছিল। খোলপেটুয়া নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বেতনা নাম নিয়ে ভারতে যমুনা নদীতে মিলিত হয়। অতীতে ভারতের কোলকাতা থেকে পণ্য নিয়ে বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার ও পালতোলা নৌকা বেতনার বুকে চলাচলা করতো। ৪/৫ হাত উঁচু তুফান আসতো। বেতনার মতই প্রবানমান ছিল নদী তীরের মানুষের জীবনযাত্রা। ব্যবসা-বাণিজ্য, ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে সবদিক থেকে এই জেলার মানুষের অবস্থান খুব ভালো ছিলো।

বেতনার সমৃদ্ধ অতীত-ঐতিহ্য এখন কেবল স্মৃতি!

বেতনা নদীর আগের সেই প্রবাহ এখন আর নেই। বেতনাকে হত্যার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৬০ এর দশকে। ওই সময় বেতনা পাড়ের মানুষের কোন প্রকার অনুমতি ও সম্মতি ছাড়াই অপরিকল্পিত স্লুইচগেট নির্মাণ করে প্রবাহমান বেতনা নদীকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। বেতনা নদীর বাঁকে বাঁকে তৈরি করা হয় ২০টি স্লুইচগেট। এই প্রসঙ্গে পশ্চিম মাছখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুরমান বলেন, “১৯৬৮ সালে বেতনা নদীকে পরিকল্পনা করে গলাটিপে হত্যা করা হয়। তৎকালীন সময়ে জলাবদ্ধতা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য এই স্লুইচগেটগুলো নির্মাণ করা হয়। কিছুকাল সুবিধা পেলেও স্লুইচগেট বেতনা নদীকে মেরে ফেলেছে। সেই সময় প্রকল্প দিয়ে বেতনা নদীর কোমরপুর, কুল্লা, সুপারিঘাটা, তেঁতুলডেঙ্গী, দামারপোতা, শাল্যে, বেড়াডেঙ্গী, গোবিনাথপুর, খেজুরডেঙ্গী, বিনেরপোতা গুচ্ছগ্রাম, বিনেরপোতা খামার, কুঞ্জুরডেঙ্গী, পারশাল্যে, কামারডেঙ্গী, মাটিয়াডাঙ্গা, ও গুনাকারকাটিতে স্লুইচগেট তৈরি করা হয়।” তিনি আরও বলেন, “বেতনা নদীকে ক্ষত-বিক্ষত করার কারণে প্রবাহমান নদীটি ধীরে ধীরে নদী মৃত পথযাত্রী হতে থাকে। প্রাকৃতিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদী তার ¯্রােত হারাতে থাকে। একে একে বন্ধ হয়ে যায় মালামাল পরিবহনের বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার ও নৌকা চলাচল। ৩০ বছরের মধ্যে বেতনা তার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। বেতনার বুকে গড়ে উঠেছে ধু ধু বালুচর।” অন্যদিকে মাছখোলা গ্রামের প্রবীণ কৃষক শাহাবুদ্দীন বলেন, “চোখের সামনে বেতনার মরণ দেখেছি। ভাবা যায়, বেতনার বুকে হাঁসের পা ডুবে না! নদীর চর দখল করে তৈরি হয় ইটভাটা ও অনেক অবৈধ স্থাপনা। হয়তো অনেক আকুতি মিনতি করেছিল বেতনা বাঁচার জন্য।” বেতনাকে হতাা করার ফলে, ৮৮, ৯১, ৯৮, ২০০০, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭ ও ২০১১ সালের ভয়াবহ বন্যা বেতনা পাড়ের জীবনযাত্রাকে লন্ডভন্ড ও সর্বশান্ত করেছে। বেতনাও বোধহয় এই কারণে প্রতিশোধ নিয়ে চলেছে ধারাবাহিকভাবে!

বেতনাকে হত্যার ফলাফল জলাবদ্ধতা: বিপর্যস্ত সাতক্ষীরাবাসীর জীবন-জীবিকা

বেতনাকে হত্যার কারণে সাতক্ষীরা বেশি কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে; দূর্বিসহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। বর্তমানে উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রামের মানুষ ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় জীবনযাপন করছে। জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইউপি সদস্য আবুল খায়ের বলেন, “জলাবদ্ধতায় মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে। বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছরের জলাবদ্ধতায় ধান ও কাজ না পেয়ে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। কাজের জন্য বাইরে চলে যাচ্ছে। এলাকায় পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। গাছপালা মরে যাচ্ছে। মানুষ অভাব-অনটনে বসবাস করছে।” তিনি আরও বলেন, “জলাবদ্ধতা থেকে সাতক্ষীরাবাসীকে বাঁচাতে হলে বেতনা নদীর খনন জরুরি। কারণ নদী ভরাট হয়ে গেছে।” মাছখোলা গ্রামের কৃষক ও শিক্ষক আব্দুল কাদের বলেন, “বেতনার সাথে সাথে আমাদের সব স্বপ্নও শেষ। আমার ৫ বিঘা কৃষিজমিতে ৫০ বস্তা ধান পেতাম, যা থেকে পরিবারের সারাবছরের খাবারের চাহিদা পূরণ হত। জলাবদ্ধতায় গত কয়েক বছর আর ধান চাষ করতে পারি না। এখন খোরাকী কিনতে হয়। ৪টি আম গাছ থেকে ২৫ হাজার টাকার আম বিক্রি করতে পারতাম। কিন্তু জলাবদ্ধতায় সব শেষ।” তিনি বলেন, “বেতনা নদীকে খনন না করলে সাতক্ষীরা পৌরসভা, ধুলিহর, লাবসা, বল্লী, ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের ৩ লাখ মানুষ প্রতিবছর পানিবন্দী হয়ে পড়বে।” মাছখোলা গ্রামের নারী মমতাজ বেগম বলেন, “একসময় আমার পরিবারের সব চাহিদা বাড়ি থেকে পূরণ হত। ধান, শাক, সবজি, মাছ, ফল সবই বাড়িতে হত। পরিবারের খরচ শেষে মাসে ২/৩ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে পারতাম। ২০১১ সাল থেকে ভয়ংকর জলাবদ্ধতায় সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে। কোন শাক সবজি চাষ করতে পারি না। বসতবাড়ির আম, কাঁঠাল, কলা ও পেঁপে গাছ মরে গেছে। এ বছর আমার পুকুরের ১০ হাজার টাকার মাছ ভেসে গেছে।” এ বছর জুলাই মাসে অবিরাম বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যার স্রোতে বেতনা নদীর আমোদখালি স্লুইচ গেট ভেঙে সাতক্ষীরার আমোদখালি বিল, হাজিখালি বিল, পালিচাঁদের বিল, খড়িবিল, বুড়ামারা বিল, ঢেপুর বিল, চেলার বিল, কচুয়ার বিলসহ ১২টি বিলে কানায় কানায় পানিতে ভরে যায়। এতে শত শত মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে যায়, চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমন ধানের বীজতলা ও অন্যান্য ফসল।

বেতনাকে পূর্ণজীবিত করতে কিছু উদ্যোগ

মানুষ এখন জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করছে। প্রতিনিয়ত মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, সভা, সেমিনার, মতবিনিময়সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এ বছর জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে পানি নিস্কাশনের জন্য ৬টি বিদ্যুৎ চালিত মটর স্থাপন করা হয়। তবে বেতনা নদীকে খনন ছাড়া জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে বাঁচার কোন পথ নেই বলে মনে করে বেতনা পাড়ের মানুষেরা। বেতনা নদীকে পুর্ণজীবিত করতে এবং স্থানীয়দের জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচাতে সরকারও বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছিলো। জলবায়ু ট্রাস্ট থেকে কিছু টাকাও বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে বিগত বছরে ব্লুগোল্ড প্রকল্পের মাধ্যমে আবারও বেতনা খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শত শত শ্রমিক মাটি কেটে তীরে ফেলে রাখে। তবে সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতির কারণে সেই উদ্যোগও সফল হয়নি।

প্রকৃতি নিজেই বেতনাকে পূর্ণজীবিত করার দায়িত্ব নিয়েছে

মানুষের লোক দেখানো উদ্যোগ যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে তখন প্রকৃতি নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে বেতনাকে বাঁচানোর! অলৌকিক হলেও সত্য যে, প্রকৃতির হস্তক্ষেপে একটু একটু করে আবারও বেতনা গভীরতা পাছে, সৃষ্টি হয়েছে পানিপ্রবাহও! যে বেতনায় হাঁসের পা ডুবতো না, সেই বেতনায় এখন তাল সমান পানি। এ সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা শাহাবুদ্দীন বলেন, “আমি ১৫ দিন আগে (আগস্ট ২০১৫) একটি কোদাল হাতে করে বেতনার মাঝখানে নামি। আমিসহ হাতের কোদালও পানিতে ডুবে যায়। বুঝতে পারি ৯/১০ ফুট গভীরতা পেয়েছে বেতনা।” ২০০০ এবং ২০১১ সালের বন্যায় বিলের পানি বেতনায় নামতে থাকলে সৃষ্ট স্রোতে বেতনা বেশ গভীর হয়। হঠাৎ সেপ্টেম্বর মাসের (২০১৫) মাঝামাঝি সময় থেকে উজান থেকে আসা বেতনায় পানির ¯্রােত চোখে পড়ে মানুষের। প্রবল ¯্রােতে পলি কেটে যাচ্ছে। এলাকাবাসী জানান, জেয়ালার গেট হতে শ্যালের ঘোলের কান্দা পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ৬ ফুট গভীরতা দেখ দেয়। বেতনার মধ্যভাগের পলি কাটতে কাটতে প্রতিদিন সামনের দিকে যাচ্ছে। নদীর গভীরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে, একদিকে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে জলাবদ্ধতায় জমে থাকা সকল বিলের পানি নিস্কাশন সম্ভব হবে। প্রাকৃতিক নিয়মে বেতনা খনন হচ্ছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রতিদিন শত শত মানুষ বেতনা পাড়ে জমা হয়। সরজমিনে দেখা যায়, প্রাকৃতিক নিয়মে নদী খনন এলাকায় বিভিন্ন খাবারের দোকান বসেছে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষেরা রোগমুক্তির জন্য পূজা, মানত করছে এবং পানি নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো প্রকৃতি প্রবাহমান বেতনার সেই যৌবন আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু প্রতিবছর একটু একটু করে পলি অপসারণ করে একসময় বেতনাবাসীর জীবনের দূর্ভোগ লাঘব করতে পারবে বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি নদী বাঁচাতে সবার আগে দরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

(তথ্যসূত্র:স্থানীয় জনগণ, বিয়াস, দৈনিক প্রত্রদূত, দৈনিক কালের চিত্র ও সাংবাদিক আসাদুজ্জামান)।

happy wheels 2

Comments