বিপন্ন মানিকগঞ্জের বিপ্র-বেতিলা গ্রাম
মানিকগঞ্জ থেকে নজরুল ইসলাম
“একূল ভাঙে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা” গানে এই কথাটি বাস্তবতার নিরিক্ষেই আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। নদীর ধর্মই হলো সবকিছুকেই সে তার ভেতরে বিলীন করে দেয়। আবার সেই নদীই মানুষকে ভাসায়-বাঁচায়, নতুন প্রাণ দেয় ফুল ও ফসলের মাঠে। বাংলাদেশে ২৩৪ নদী রয়েছে আর প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে অভিন্নভাবে আছে ৫৫টি নদী (তথ্য: নদী কমিশন)। ভৌগলিকভাবে আমরা ভাটির দেশের মানুষ এবং স্বাদু ও মিঠা দুই ধরনের পানিই আমাদের নদীগুলোতে আছে। আমাদের নদীগুলো খুবই বৈচিত্র্যময়। নদী যেমন আমাদের দেয় দু’হাত ভরে একইভাবে সে যখন রুদ্ধ মূর্তি ধারণ করে তখন সবকিছুকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়-বিলীন করে দেয়।
এমনইভাবে নদীর করাল গ্রাসে প্রায় বিলীন হতে যাচ্ছে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বিপ্র-বেতিলা (সৈয়দপুর)। মানিকগঞ্জ ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত হলেও ধলেশ্বরী আজ মৃত প্রায়। পদ্মার শাখা নদী জাফগঞ্জ হয়ে প্রাচীন ধলেশ্বরী বর্তমান কালিগঙ্গা নাম ধারণ করে ঘিওর উপজেলার শ্রীধর নগর, পেঁচারকান্দা, কাউটিয়া, জাবরা, তরা হয়ে সদর উপজেলার বেউথা, বোয়ালী, কুশেরচর হয়ে বেতিলা, বিপ্রবেতিলা (সৈয়দপুর), সানমান্দা হয়ে হরিরামপুর পদ্মায় মিলিত হয়েছে। তাই বলতে হয়, কালিগঙ্গা নদীতে ভাঙনের কবলে আক্রান্ত হয়েছে ইতেমধ্যো শ্রীধরনগর, বেগুননারচী, চরবাইলজুরি, মাইলাগি, পেঁচারকান্দা, সাইংজুরি, কাউটিয়া, জাবরা, তরা, বেউথা, বান্দুটিয়া, চামটা, বিপ্র-বেতিলাসহ অনেক গ্রাম।
এই প্রসঙ্গে গ্রামের কৃষক মো. আশক আলী বলেন, “এই গ্রাম খুবই ঐতিহ্যময়। ১৩০টি পরিবার নিয়ে এই গ্রাম বিপ্র-বেতিলা। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ এখানকার মানুষের আছে লড়াই সংগ্রামের বিশাল ইতিহাস। গ্রামের শ্রমজীবী, কৃষকরা বারবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। এই গ্রামের অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে দেশ বিদেশে চাকরি করছে। বর্তমানে এই গ্রামে শিক্ষার হার ভালো এবং সব পরিবারেই শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর আছে।” তিনি আরো বলেন, “সম্প্রতি নদী ভাঙনের ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াতেও অনেক সমস্যা হচ্ছে। আমাদের ফসলের জমি হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা একটি দুর্বিসহ জীবন কাটাচ্ছি।” এ বিষয়টি অবগত করার জন্য তার গ্রামের মানুষ স্থানীয় চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক পর্যন্ত গেছেন এবং গ্রামবাসীর পক্ষে কৃষক নেতা কফিল উদ্দিন বুলড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন বন্ধে উচ্চ আদালতে রীট করলে উচ্চ আদালত গ্রামবাসীর পক্ষে রায় দেয় কিন্তু এখনো মাটি উত্তোলন বন্ধ হয়নি বলে তিনি জানান।
সৈয়দপুর গ্রামের কৃষকনেতা মো: কফিল উদ্দিন (৭৩) বলেন, “আমরা সারাজীবন নদীর সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। কত শতবার যে ভাঙা-গড়ায় পড়েছি তার হিসাব নেই। কিন্তু এই ভাঙা গড়ার কারণ হলো আমরা মানুষ। আমরা নির্বিচারে নদী খনন করি কিন্তু তার প্রভাব কি পড়তে পারে তা হিসেব করি না। অপরিকল্পিত খননের ফলেই আজ আমরা এই দুর্বিসহ জীবন অতিবাহিত করছি।”
এলাকাবাসীরা জানান, ভাঙনের সাথে পরিবারগুলোর পাশাপাশি গাছপালা, পশু, পাখিসহ অন্যান্য অসংখ্য জীবজন্তুও আজ আক্রান্ত। তাই প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে ও পরিকল্পিত নদী ব্যবস্থাপনার দ্বারাই এই সংকট দূর হবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। আর তার মাধ্যমেই রক্ষা পাবে ঐতিহ্যবাহী গ্রাম বিপ্র-বেতিলা।
উল্লেখ্য যে, কালীগঙ্গা নদী খননের জন্য বুলড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন করা হয়। তবে মাটি উত্তোলন এই প্রক্রিয়াটি পরিকল্পিতভাবে না করায় নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোর মাটিও ধ্বসে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে অনেকগুলো পরিবারের বসতভিটে নদীতে মিশে গেছে।