মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মানিকগঞ্জের মা ও নবজাতক শিশুরা
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা
ঘিওর উপজেলার বাষ্টিয়া প্রাইমারী স্কুল মাঠে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গ্রাম্য মেলার নাগরদোলাটি ঘুরছে চক্রাকারে। শিশু কিশোর-কিশোরীরা সেই নাগর দোলায় চড়ে দুলছে। চারদিক বাঁশি আর হাজারো মানুষের কলধ্বনি। পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে তা উপভোগ করছে আছমা নামের এক ১৫ বছরের কিশোরী। পাশের গাঁয়েই তার বাড়ি। হয়তো এসময় মেলার ওই নাগরদোলায় চড়ে ঘুরতে সেও থাকতে পারতো। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। কারণ সে যে বিবাহিতা, তার কোল জুড়ে তিন মাসের এক ফুটফুটে শিশু সন্তান। ঘিওর উপজেলাতেই নয়, মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় এরকম হাজারো বাল্য বিয়ের কবলে পড়ে অনেক কিশোরীর স্বপ্ন ধুলিসাৎ হচ্ছে। সেই সাথে এসব কিশোরী মা ও তাদের সন্তানাদীও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো মাতৃমৃত্যু, প্রসূতি মায়ের যতœ এবং প্রসব পরবর্তী মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অনেকটা সেকেলে পন্থাই অবলম্বন করা হয়ে থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সেইসাথে বাল্য বিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ ও প্রসব পরবর্তী মা ও শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। কম বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে অল্প বয়সী নারীরা পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে যথেষ্ট জানতেও পারছেন না।
বানিয়াজুরী এলাকার কিশোরী মা লিপি আক্তার বললেন, “তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। শখ করে আমার অভিভাবকরা আমার বিয়ে দিয়ে দেন। সেই সময় আমার বয়স ছিল ১৪ বছর। সংসার কি জিনিসি তা বুঝে ওঠার আগেই হাল ধরতে হয় সংসারের। এক বছর পরেই কোল জুড়ে আসে এক সন্তান। তারপর থেকেই শরীরে একটা না একটা রোগ লেগেই আছে। এখন আর শরীরে তেমন জোর পাই না। ঠিকমত যত্নে নিতে না পারায় শিশু সন্তানটিও নানা অসুখে আক্রান্ত হয়েছে।”
সরজমিন উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের মা ও শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে এরকম অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। উপজেলার আশাপুর গ্রামের লাবণী আক্তার ও আমেনা বেগমের সংসারে দু’টি করে সন্তান রয়েছে। তারা জানান, তাদের দু’জনেরই ১৫-১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ৩ বছরের মাথায় তাদের দু’টি করে সন্তানের জন্ম হয়েছে। বিয়ের পর পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে তারা কিছুই জানতো না। সংসারে অস্বচ্ছলতার কারণে রোগ ব্যাধির সুচিকিৎসা করাতে পারছেন না। বানিয়াজুরী ইউনিয়নের রাথুরা গ্রামের লাভলী আক্তার, পারভীন আক্তারেরও বিয়ে হয়েছে খুব কম বয়সে। সন্তানাদীসহ তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুকিতে রয়েছে।
উপজেলার বরটিয়া এলাকার সাবিনা ইয়াসমিন ও রুপা আক্তারের বিয়ে হয়েছে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে। বিয়ের চার বছর বয়সে তাদের ঘরে দু’জন করে সন্তান। তাদের স্বামী দিনমজুর হওয়ার কারণে খাদ্য, চিকিৎসা ও পুষ্টিহীনতায় ভূগছে। রুপা আক্তার বলেন, “সংসারে কৃষাণীর কাজ করি, শরীরে বল পাইনা, চোখে ঝাপসা দেখি।” শুধু সাবিনা আর রুপাই নয় উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে হাজারো কম বয়সী কিশোরী মাতারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
ত্বরা মির্জাপুর গ্রামের সোনিয়ার বিয়ে হয়েছে ৫ম শ্রেণী পড়া অবস্থায়। তার অভিভাবক নানা হাকিম উদ্দিন বলেন, “দিনকাল ভালো না। তাই ভালো ঘর আর ভালো বর পেয়ে একটু আগেই বিয়ে দিয়েছি।
উপজেলার বালিয়াখোড়া ও রাথুরা গ্রামের মণিদাশ পাড়ার মেয়েদের বিয়ে হয় খুব অল্প বয়সে। দশ থেকে পনের বছরের মধ্যেই তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। শিপ্রা রাণী দাশ, কাজল দাশ, চায়না রাণী দাশের ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে তাদের সমগোত্রীয় ছেলেদের সাথে। এত অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় সংসার তো ঠিকমত করতেই পারেন না আবার তারা নিজেরাও স্বাস্থ্যগত নানান অসুখে ভোগেন। এবিষয়ে ঘিওর উপজেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, বাল্য বিয়ে এখন অনেকটা কমে এসেছে। এরপরও কোন বাল্য বিয়ের খবর পেলে উপজেলা প্রশাসন থেকে তা বন্ধের জন্য সব পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।
জাবরা উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. আবুল হাসান এ প্রতিবেদককে জানান, অল্প বয়সে বিয়ে হলে তাদের শরীর ও মনে একটা চাপ পড়ে। এরপর তাদের সন্তান হলে সেই কিশোরী মার স্বাস্থ্যগত নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এরকম বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে তার সন্তানও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে।
সপ্তম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী শেষ না হতেই বিয়ে হচ্ছে কিশোরীদের। এখন যেসব নারীর বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছর, তাদের অধিকাংশের বিয়ে হয়েছিল ১০ থেকে ১৫ বছর আগে। কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য পরিবারই দায়ী। কম বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে অল্প বয়সী নারীরা পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে যথেষ্ট জানতে পারছেন না। সরকারি বা বেসরকারিভাবে বাল্য বিয়ে বন্ধ করতে না পারলে হাজারও নারী ও শিশু মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে।