মনোবল ও পরিশ্রম খেলন রাণীর সফলতার চাবিকাঠি
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
কাক ডাকা ভোরে গ্রামের প্রতিটা বাড়ির লোকজন যখন ঘুমের ঘোরে অচ্ছন্ন, ঠিক তখন বাড়ির উঠানের উনুনে আগুন জ্বালান খেলন রানী। আর তার পাশে পরিস্কার করে হাত ধুয়ে বসে আছে গ্রামের আরো ১০ জন অতি দরিদ্র নারী, আলো আধারে খেলন রানীর সাথে লাড়– বানানোর জন্য। প্রায় ১৮ বছর ধরে একই নিয়মে খেলন রানীর উঠানের উনুনে আগুন জ্বলে চলেছে। আর সেই সাথে এ আগুন খেলন রানী ছাড়াও আরো ১০ জন দারিদ্র নারীর অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে একটু একটু করে আলোকিত করে তুলছে। ভোর থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত চলে তাদের চিড়া ও মুড়ির লাড়–, আঙ্গুর ভাজা ও হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি। দুপুর পর্যন্ত কাজ করে তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সংসারে গিয়ে ঘর কন্যার কাজ শেষে আবার বিকালে খেলন রানীর বাড়িতে এসে সেগুলো প্যাকেট করে বাজারে বিক্রির প্রস্তুত করে। রাত ৮টা পর্যন্ত চলে এ প্রক্রিয়া। কেননা কিছুক্ষণ পরই খেলন রানী এসব প্যাকেট নেত্রকোনা সদর উপজেলার মেছুয়া বাজারে আরাধন সাহার দোকানে পৌছে দেবেন। প্রতি প্যকেটে লাড়–ৃ থাকে ২০টি করে, পাইকারী মূল্য ২০ টাকা। নেত্রকোনা জেলার মেছুয়া বাজারের দোকানদারের নিকট থেকে এই লাড়– নেত্রকোনা সদর উপজেলার বিভিন্ন দোকান, বাজার এমনকি ফেরিওয়ালার মাধ্যমে ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে পৌছে। খেলন রানী মাঝে মাঝে লাড়–র প্যাকেটের চাহিদা বাড়ানোর জন্য প্যাকেটের ভেতর লেবেলে লটারির ব্যবস্থা করেন। এতে করে বাচ্চাদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। যদিও নেত্রকোনাবাসীর কাছে খেলন রানীর লাড়– মায়ের হাতে বানানো মুয়ার ন্যায় পরিচিত।
নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার চকপাড়া নামক স্থানে খেলন রানীর বাড়ি। স্বামী রাজমিস্ত্রী তপনচন্দ্র দাস। স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করে যা আয় হয় সেটা দিয়ে প্রতিদিন উনুনে আগুন জ্বলতো না। মোট ছয় জনের সংসার স্বামীর সামান্য আয় দিয়ে চলা দায় হয়ে পড়ে। এ প্রসংগে খেলন রানীর ভাষ্য “প্রায় দিনই এক বেলা খেলে অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হতো। অভাবের তাড়নার বাড়ির বাইরে কাজ করতে যাব কিনা ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না।” প্রতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকায় নেত্রকোনার বাইরে কোথাও কাজ করার নিরাপদ মনে করছিল না তার। কিন্তু অভাব তাকে ও তার পরিবারকে চারপাশ থেকে ক্রমেই ঘিরে ধরছিল। এ অবস্থায় ছেলে বেলায় মায়ের কাছে শেখা মুড়ি ভাজা লাড়–ু বানানোর কথা মনে পড়ে তার। এভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ঘরে বসে মুড়ি ভেজে লাড়– তৈরি করে নিজেই দোকানে দোকানে বিক্রি করবেন। আজ থেকে ১৮ বছর পূর্বে মাত্র ১,০০০ টাকা (এক হাজার) পুঁজি করে কোলের শিশুটিকে ঘুম পাড়িয়ে একা হাতে শুরু করে নাড়– তৈরি ও প্যাকেট করে নেত্রকোনার দোকানে দোকানে যোগান দেওয়া। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলে তার দোকানে দোকানে গিয়ে বিক্রির টাকা সংগ্রহ করা। এত রাত পর্যন্ত একজন নারী দোকানে বসে থাকার দৃশ্যটি সকলের চোখে পড়ে। এ সর্ম্পকে তিনি বলেন, “প্রথম দিকে আমার এ কাজটিকে অনেকেই ভালো চোখে দেখেনি, এখন সমাজ পালটাইতাছে, নারীরা বাইরের কাজে যাইতাছে কিন্তু আমাদের মত দরিদ্র পরিবারে নারীরা সরাসরি কোন দোকানের সাথে লেনদেন করাকে সমাজ ভালোভাবে নেয় না”।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না থাকার কষ্ট খেলন রানীকে সব সময় কষ্ট দিয়েছে, তাই সংগ্রামী জীবনে তার একটি বড় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সন্তানদের লেখাপড়া শেখানো। তিনি আয়ের একটি অংশ ব্যয় করেন তিন সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে। তার বড় ছেলে এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে, মেজ ছেলে দশম শেণীতে এবং ছোট ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে।
এক হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে খেলন রানী যে জীবন যুদ্ধ শুরু করেছিলেন বর্তমানে যুদ্ধে তার ১০ জন সহযাত্রী হয়েছে, যারা সবাই দরিদ্র পরিবারের নারী। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ জন নারীই প্রতি মাসে আয় করছে গড়ে ২,৫০০-৩,০০০ টাকা।
খেলন রানী তার আয় দিয়ে সংসারে প্রয়োজনীয় ফার্নিচার কিনেছেন। বাড়ি তৈরির জন্য তিনি একটু জায়গা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের তৈরি মুড়ি ও চিড়া ভাজা নাড়–র প্রতিযোগিতার বাজারে এতগুলো বছর টিকে থাকা এবং দিন দিন মানুষের নিকট জনপ্রিয়তা পাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি পরিস্কারভাবে খাবারগুলো তৈরি করি, খাবার তৈরির সময় মনে করি এগুলো আমার সন্তানরা খাবে, তাই খাবারে কোন ধরনে ক্যামিকেল বা বিষাক্ত কিছু ব্যবহার করি না।”
খেলন রানী অদম্য মনোবলের ফলে সহকর্মীদের নিয়ে তিনি আজ যে অবস্থানে পৌছেছেন তার ইচ্ছা ভবিষ্যতে দরিদ্র নারীদের নিয়ে নিরাপদ খাদ্য তৈরী ও বাজারজাত করে সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় ভুমিকা রাখবেন। খেলন রানীর এই উদ্যোগ ও সফলতা গ্রামীণ দরিদ্র নারীদেরকে নিজে চেষ্টায় স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখাবে বলে আমরা আশাবাদী।