ফুলে ফুলে রঙিন স্বপ্ন
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক
ফুল সার্বজনীন সৌন্দর্য ও শান্তির প্রতীক। আজ থেকে ১৩ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ফুল গাছের উদ্ভব ঘটে। পৃথিবীতে প্রায় আড়াই লক্ষ প্রজাতির ফুল রয়েছে। উদ্ভিদ জগতে ফুলই বংশবিস্তার ও সংখ্যা গরিষ্ঠতায় এগিয়ে। এদের মধ্যে থেকে কিছু সংখ্যক ফুল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আবাদ হচ্ছে মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর, সিংগাইর, শিবালয় ও সাটুরিয়া এলাকায়।
সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হয় সিংগাইরের তালেবপুর, বায়রা, জয়মন্টপ, সায়েস্থা ও ধল্লায়। এসব এলাকায় মাঠের পর মাঠ ফুলের সমারোহ দেখে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকেন সবাই। জেলায় প্রায় সাড়ে ৩শ’ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষের মধ্যে শুধু সিংগাইরেই প্রায় ২শ’ হেক্টর জমিতে হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের আবাদ। এদের মধ্যে বাহারী রঙের গোলাপ, গ্লাডিওলার্স, গাঁধা, বেলি, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, লিলি, টিওলিব, ডালিয়া, চম্পা, হাসনাহেনা, শিউলি, ড্যাফেডিল, চন্দ্রমল্লিকা, লুপিন, ডায়ান্থাস, নিংগ্লোরি র্যাফেলেসিয়া, মাধবী লতা, নাগালিঙ্যাম, অর্কিড ফুলের চাহিদা বেশি হওয়ায় এর আবাদ তুলনামূলকভাবে বেশি হচ্ছে।
বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করে মানিকগঞ্জের দেড় শতাধিক ফুলচাষি এখন স্বাবলম্বী। ফুলেই ঘুরেছে তাদের ভাগ্যের চাকা। তাদের সাফল্য দেখে উৎসাহিত হয়েছেন এলাকার অনেক কৃষক। এক্ষেত্রে শিক্ষিত বেকার যুবকদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। অনেকেই এখন চাকুরি নামক সোনার হরিনের পিছু না ছুটে ফুল চাষ করে ঘুচিয়েছেন বেকারত্ব। ফুল আবাদ, পরিচর্যা ও আহরণ শ্রমিক, পরিবহন, বিক্রিতে চাষী ছাড়াও আরো বেশ কয়েক হাজার লোকের জীবিকা এই ফুলের সাথেই ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।
জয়মন্টপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শাহাদৎ হোসেন বলেন, “শুরুতে কয়েকজন কৃষক ফুলচাষ শুরু করেন। ফুলচাষে লাভ হওয়ায় দিন দিন এলাকার কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। আমার দেখা অনেক বেকার যুবকই ফুলচাষ করে ঘুঁচিয়েছে তাদের বেকারত্ব।”
ফুলচাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন এমন কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে তাদের সাফল্যের কথা জানা গেল। ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী এলাকার আব্দুর রশিদ বলেন, “ফুলচাষ করেই স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছি। বর্তমানে আমার ফুলের নার্সারিতে ৮/১০ জন শ্রমিক কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। আমার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই ফুলচাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।”
ধল্লার ফোর্টনগর গ্রামের ফুলচাষি ইসহাক মিয়া জানান, ধলেশ্বরী নদীর পাশে অবস্থিত হওয়ায় তাদের জমিতে বালুমাটির প্রাধান্য দেখা যায়। এ ধরনের জমিতে ফসল তেমন হয় না। তাই ২০০৩ সালের দিকে ব্যক্তিগতভাবে বাড়ির আঙিনায় ৫ শতাংশ জমিতে ফুলচাষ করেন। প্রথমবার লাভ ভালো হওয়ায় ফুলচাষে ঝুঁকে পড়েন। পরেরবছর চার বিঘা জমিতে ফুলচাষ করেন। তারপর থেকে শুরু হয় সাফল্যের ধারা। তিনি বলেন, “১০ বছর আগেও আমার নুন আনতে পান্তা ফুরায়- এমন অবস্থা ছিল। এখন ফুলচাষ করে আমি স্বচ্ছল। ফুলচাষই আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছে।”
ফুলবাগানে কর্মরত শ্রমিক আলমগীর জানান, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ব্যাপক ফুলচাষ হওয়ায় কমে যাচ্ছে বেকারত্বের হার। ফুলবাগানে কাজ করে দিনপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পাচ্ছেন। তা দিয়ে সংসার চালা”েনছ। ফুলবাগান হওয়ায় তাদের সুবিধা হলো- এখানে প্রতিদিনই কাজ পাওয়া যায়।
বায়রা এলাকার ফুলচাষি রফিকুল ইসলাম জানান, বীজ বপনের তিন মাসের মধ্যেই ফুল পাওয়া যায়। তাই ফুলচাষে হাতে নগদ টাকা পাওয়া যায় তাড়াতাড়ি। তবে বাজারে ফুলের প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় ফুলচাষিরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান তারা। এদিকে কৃষি বিভাগের পরামর্শ পেলে উৎপাদন আরও ভালো হতো বলে ফুলচাষিরা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “ফুলচাষের খরচ অনেক। তবে লাভও অনেক। ফুলচাষের জন্য আমাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হলে আমরা বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব।”
মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আলীমুজ্জামান মিয়া জানান, ফুলচাষের প্রতি মানিকগঞ্জের অনেক চাষীই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। দিন দিন বাড়ছে ফুলচাষির সংখ্যা। চাষিরা যাতে ফুলচাষে আরও ভালো করতে পারেন, সে জন্য তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ, মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার্য্য সহায়তাসহ তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। এ অঞ্চলের মাটি ফুলচাষের উপযোগী হওয়ায় চাষিরা সহজেই লাভবান হতে পারেন বলে জানান তিনি।