অচাষকৃত উদ্ভিদগুলো আমাদের নিরাপদ খাদ্যের উৎস
সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে শাহিনুর রহমান
গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের অপুষ্টি দূরীকরণে যুগ যুগ ধরেই ভূমিকা রাখছে বাহারি রকমের অচাষকৃত উদ্ভিদ বৈচিত্র্য । বাংলাদেশের খাল-বিল, নদী-নালা, পতিত জমি, বাড়ির আশপাশেই রয়েছে এসব উদ্ভিদ বৈচিত্র্যগুলো। যে উদ্ভিদগুলো মানুষের নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টির আধাঁর হিসেবে ব্যবহার হয়। আবার যেগুলো মানুষ খায় না সেগুলো পশু খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয়। নিরাপদ খাদ্যের জন্য এসব উদ্ভিদ বৈচিত্র্যগুলো সংরক্ষণ করা যেমন জরুরি, তেমনি এর ব্যবহারও বাড়ানো দরকার। এসব অচাষকৃত উদ্ভিদ গ্রামীণ স্থানীয় মানুষ কিভাবে ব্যবহার করছে এবং সংরক্ষণে তারা কি ধরনের ভূমিকা রাখছে সে বিষয়ে জনগোষ্ঠির মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং উদ্ভিদ বৈচিত্র্যগুলো চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও ব্যবহার বৃদ্ধি করতে বারসিক’র উদ্যোগে অচকষকৃত উদ্ভিদের ব্যবহার, বিকাশ,সংরক্ষণ ও পুষ্টি বিষয়ক অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রতি।
কাস্তা বারোওয়ারি কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সভাপতি ভানু রায়ের সভাপতিত্বে বারসিক কর্মকর্তা শাহিনুর রহমানের সঞ্চালনায় বারসিক কর্মকর্তা শিমুল বিশ্বাসের স্বাগত বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা রতন চন্দ্র মন্ডল। আরো অংশগ্রহণ করেন সিংগাইর উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের নয়াবাড়ি গ্রামের কৃষাণি, জয়তুন বেগম, কমলা বেগম, কৃষক ইব্রাহিম মিয়া একই উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের কাস্তা গ্রামের কৃষাণি লিপিকা মন্ডল, কৃষক আব্দুল হালিম, বাংগালা গ্রামের কৃষক সুভাষ মন্ডল, মানিকগঞ্জ জেলা নারী উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সেলিনা বেগম, হরিরামপুর উপজেলার বাহিরচর নারী উন্নয়ন সংগঠনের সদস্য ভাগ্যলিপি সরকার, হরিরামপুর পদ্মাপাড়ের পাঠশালা পরিচালক মীর নাদীম ও বিপুল হালদার, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বাংগড়া কৃষক কৃষাণী সংগঠনের সভাপতি আছিয়া বেগম, যুব সদস্য সুমন আহমেদ, বারসিক মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক সমন্বয়কারি বিমল রায় ও বারসিকের অন্যান্য কর্মকর্তা বৃন্দ।
আলোচনায় রতন চন্দ্র মন্ডল বলেন, একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ২ শত গ্রাম শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা খাই মাত্র ৬০-৭০ গ্রাম। তাই চাওয়া-পাওয়ার এ গড় মিলে আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক দৈহিক এবং মানসিক অসুখে ভুগছেন। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছেন শিশু ও নারী। নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি ছাড়া দেহ কাজ করতে অক্ষম।নিরাপদ পুষ্টি যুক্ত খাবার দেহকে বাড়িয়ে তোলে এবং বৃদ্ধি ও মেরামতের জন্য পুষ্ট করে তোলে। এ কারণে প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাবার রাখা উচিত। শরীরের সঠিক পুষ্টি সরবরাহের জন্য সঠিক উপাদানগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যদি নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার এবং প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর খাবার খান তাহলে আপনার শরীররে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। আর এই প্রাকৃতিক খাবারের উৎস হচ্ছে অচাষকৃত উদ্ভিদ।এসব উদ্ভিদ সংরক্ষণে উদ্যোগী মানুষকে আমরা সরকারিভাবে সহায়তা করবো।‘
আলোচনায় মীর নাদীম তার বক্তবে বলেন, ‘আমরা জীবন ধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণ করি। খাদ্যের সঙ্গে জীবন স্পন্দনের সম্পর্ক সরাসরি। নির্ভেজাল, পুষ্টিকর খাবার পরিমিত গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ খাবার আমাদের সুস্থ জীবনের নিশ্চয়তা। নিরাপদ খাবার হলো সেই খাবার যা কোন মানুষ গ্রহণ করলে তার ক্ষতি হবে না, তার শরীরের পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। অচাষকৃত উদ্ভিদগুলো ব্যবহারে মাধ্যমেই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হতে পারে।’ ভাগ্যলিপি সরকার বলেন, ‘সুস্থ-সবলভাবে বেঁচে থাকতে পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে। এর চাহিদা পূরণে অচাষকৃত উদ্ভিদগুলো বেশি নিরাপদ। শাকসবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিনসহ অনেক পুষ্টি উপাদান আছে মাঠে ঘাটে পালানি জমিতে জন্মানো এসব উদ্ভিদে। এসব উদ্ভিদের পুষ্টি গুণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, খাবারে রুচি আনে। এই উদ্ভিদগুলো সংরক্ষণ করা দরকার।’ সেলিনা বেগম বলেন, ‘করোনা কালিন সময়ে আমার অচাষকৃত উদ্ভিদ সংগ্রহ করে আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছি। কিন্তু এসব প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো উদ্ভিদগুলো দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কল কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য বিষিয়ে তুলছে মাটি, বায়ু এবং পানি। তাছাড়া জমিতে অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার বিষ ব্যবহারের ফলে ক্ষেতের আইলে ডোবা নালায় জন্মানো উদ্ভিদগুলো খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের শাকের প্রাকৃতিক উৎস অনেকটাই যেন বিপর্যয়ের মুখে।’
ইব্রাহিম মিয়া বলেন, ‘আমাদের আশেপাশে,পালানি জমি,রাস্তার ধারে জন্মানো অচাষকৃত শাকসবজি পুষ্টির ভান্ডার। এসব উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে হেলেঞ্চা শাক, ঢেঁকি শাক, নটেশাক, গিমাশাক, তেলাকুচা, থানকুনি, খানকুন, বথুয়া, বন কচু, গন্ধভাদালী, কাটানটে, কলমি, দন্ডকলস, নুনিয়াশাক,পিপুল, সেঞ্চি, কানাইশাক, নুন খুরিয়া, বিষ কচু, দুধলী, কাটা কচু, চিনিগুড়া।আমাদের নতুন প্রজম্মের সন্তানরা এ সকল উদ্ভিদের পুষ্টিগুণ বিষয়ে জানে না। এগুলো সংরক্ষণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে পারিবারিকভাবে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব তা নতুন প্রজন্মকে জানানো দরকার।’