করোনাকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে বৈচিত্র্যময় ফসলের কোনো বিকল্প নেই
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
যেদিন থেকে চাষাবাদের সূচনা হয়েছিল সেদিন থেকেই কৃষি আর কৃষক শব্দ দুটো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিজের খাদ্য চাহিদা, পুষ্টি চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা আনতে কৃষিকাজের কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া বর্তমান সময়ে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারীর মতো ভয়ংকর একটি রোগ, যা থেকে দূরে থাকতে বিভিন্ন ধরণের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের গ্রাম বাংলার কৃষকগণ সারাবছর নিজেদের আঙিনায় যে সকল শস্য আবাদ করেন, সেগুলো হচ্ছে পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার। বিভিন্ন ধরণের শাকসব্জি, ফলমূল এছাড়া অচাষকৃত উদ্ভিদ-এসব কিছু থেকেই আমরা বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যোপাদান পেয়ে থাকি। তাছাড়া পুকুরে চাষকৃত স্থানীয় জাতের মৎস্য সম্পদ, হাঁস, মুরগি আমাদের প্রাণীজ পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ সকল পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করেই আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনো করোনাকে প্রতিহত করে চলেছে।দূর্গাশ্রম গ্রামের কৃষক মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি সারাবছর ধরে নানা প্রকার ফসল চাষাবাদের সাথে যুক্ত। ছোটবেলা থেকেই তিনি এ কাজে যুক্ত হয়েছেন। কৃষিকাজই তাঁর ধ্যান, জ্ঞান। কিভাবে ফসলের যতœ করতে হবে, কি পদ্ধতিতে বীজ রোপণ করলে গাছ সবল থাকবে এসকল বিষয় তাঁর নখ দর্পনে।
যে সকল সব্জী তিনি সারাবছর চাষ করেন, সেগুলো আগে নিজের পরিবারের চাহিদা পূরণ করে তারপর বিক্রি করেন। বাড়ির আঙিনার পাশাপাশি তিনি বর্তমানে ৫০ শতাংশ জায়গায় সব্জী চাষ করাসহ বেশ কিছু ফলের গাছ রোপণ করেছেন।
সিদ্দিকুর রহমানের সব্জী ক্ষেতে অনেক ধরণের সব্জী, মসলা ও ফলের গাছ রয়েছে। শিম ৩ ধরণের (আইশনা, গুতুম, ও সুন্দরী), মরিচ ২ ধরণের (বারোমাসী ও নলপায়া), টমেটো, ধনিয়া, গুয়ামুড়ি সজ, দেশিলাউ, লতিরাজ কচু, লাই, ধুন্দল, ডাটা, ২ ধরণের চুকাই, পুঁইশাক, অড়হর, তেজপাতা, গজকরলা, ঢেঁড়স, বারোমাসী বেগুন ইত্যাদি। প্রত্যেকটি সব্জীর মধ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যগুণ।
এছাড়া ফলের মধ্যে রয়েছে নারিকেল, জাম্বুরা, বুবি (লটকন), চালতা, আম, কাঁঠাল, সুপারি, এলাচি লেবু, কাগজি লেবু, জাম, গোলাপজাম, জলপাই, অড়বড়ই, লিচু, কলা, পেঁপে, বড়ই, কামরাঙ্গা ইত্যাদি। সব্জীর জমিতে লাগোয়া একটি পুকুরও আছে। সেই পুকুরে শিং, মাগুর, কৈ, পুঁটি, আইড়, চিংড়ি, রুই, কাতল, স্বরপুঁটি, মৃগেলসহ যাবতীয় স্থানীয় জাতের মাছ রয়েছে।
তিনি প্রায় সারাদিন এই সব্জী ক্ষেতে সময় কাটান। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিনি সব্জী বা ফলের গাছের পরিচর্যা করেন। কাজ করার পর সাময়িক বিশ্রাম নেয়ার জন্য এখানে ছোট্ট একটি ঘর তুলেছেন। প্রতিদিন সকালে এসে কিছু সব্জী সংগ্রহ করে স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যান। তাছাড়া প্রতিবেশিরা নিজেদের চাহিদা মতো সব্জী এখান থেকেও কিনে নিতে পারে। কেউ কেউ সব্জীর অগ্রিম মূল্য দিয়ে যান। পুকুরের পানির সাহায্যে তিনি সব্জী ক্ষেত এবং ফলজ গাছের গোড়ায় সেচ দিয়ে থাকেন। গরু, ছাগলের আক্রমণ থেকে সব্জী ক্ষেত রক্ষা করার জন্য তিনি এর চারপাশে বেড়া দিয়েছেন।
এক মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই তিনি অন্য মৌসুমের সব্জী চাষের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পাশাপাশি চলে বীজ সংগ্রহ। সব ধরণের সব্জীর বীজ তিনি সংরক্ষণ করেন। নিজে রোপণের পাশাপাশি অন্যদেরকেও বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেন। তাছাড়া চাষ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরণের পরামর্শও তিনি দিয়ে থাকেন। সারাবছর এবং বৈচিত্র্যময় সব্জী চাষের জন্য এলাকায় তাঁর বেশ সুনাম রয়েছে। তাঁকে দেখে প্রতিবেশিদের মধ্যে অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অল্প জমিতে অনেক ধরণের সব্জী চাষ শুরু করেছে।
সুস্থ ও সবলভাবে বেঁচে থাকতে হলে পুষ্টিকর খাবার খেতেই হবে এবং এসকল উপাদান আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে। বসতবাড়ির আঙিনায়, বাড়ির পাশের এক খ- জমিতে চাষাবাদ করে পুষ্টির চাহিদা অনায়াসেই পূরণ করা যায়। প্রয়োজন শুধু একটু ইচ্ছাশক্তি ও সামান্য পরিশ্রম। আমাদের দেশে প্রতিবছর পুষ্টির অভাবে অনেক মানুষ মারা যায়, অন্ধ হয়ে যায়, রক্ত শূন্যতায় ভোগে। এসব সমস্যা সমাধানে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ এসব খাবার আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে সে খাবার অবশ্যই বিষমুক্ত এবং নিরাপদ হতে হবে।