চরের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় জনউদ্যোগ

সত্যরঞ্জন সাহা, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ
“লোকসংগীত আর হাজারীগুড় মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর” হরিরামপুরের হাজারীগুড় বাংলাদেশের এক বিখ্যাত ভৌগলিক নির্দেশক। হরিরামপুর উপজেলার উপর দিয়ে পদ্মা নদী বয়ে যাওয়ায় একটি অংশ সাবক বা মেইনল্যান্ড অপরটি চরাঞ্চল। পদ্মা নদী মানুষের জীবন ও জীবিকা ও কৃষির সাথে সম্পর্কিত। তবে নদী ভাঙনে ছোট হয়ে আসছে হরিরামপুরের ফসলি কৃষি জমি ও মানুষের বসতি স্থান। হরিরামপুরে বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙন ও বজ্রপাত প্রতিবছরের ঘটনা। বজ্রপাতে প্রতিবছর মানুষসহ প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। নদীভাঙন, অবকাঠামো সুরক্ষা, বজ্রপাতের হাত থেকে এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা সুরক্ষা ও হাজারি গুড়ের ঐতিহ্যকে ধারণ করে বারসিক’র দিকনির্দেশনায় হরিরামপুর যুব স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্যরা বিগত ৬-৭ বছর ধরে নিজেরা তাল ও খেজুর বীজ রোপণ করার পশাপাশি এলাকার মানুষকে সেগুলো রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় হরিরামপুরের পাটগ্রামচর, নটাখোলা, খাড়িয়া, দিয়াবাড়ি, চালা, ইজদিয়া, দড়িকান্দি খলিলপুর রাস্তার দুই পাশে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় কয়েক হাজার তাল ও খেজুর গাছর বীজ রোপণ করা হয় সম্প্রতি। বর্তমানে এলাকার মানুষের তত্ত্বাবধানে গাছগুলো বেড়ে উঠছে। এই কর্মউদ্যোগের ফলে এলাকার মানুষের ঐতিহ্য আর স্থানীয় সম্পদ নির্ভর কর্মক্ষেত্র বিকশিত হওয়ার পাশপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবর্তীত পরিস্থিতি মোকাবেলায় তৈরি হচ্ছে আপন সম্পদ ও চর্চা নির্ভর এক স্থায়িত্বশীল ক্ষেত্র, যা এলাকার প্রাণ ও সম্পদ সুরক্ষায় কার্যকরি অবদান রাখবে বলে এলাকার মানুষ বিশ^াস করে। এলাকায় এই ধরনের বৃক্ষ রোপণের প্রাসঙ্গিকতা ও বৃক্ষরোপণসহ এলাকার মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে ২০১৮ সালে উপজেলা পর্যায়ে বারসিক হরিরামপুরকে পরিবেশ সম্মননা প্রদান করা হয়।


হরিরামপুর স্বেচ্ছাসেবক টিম ও যুবক এবং শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গত ৭ বছর ধরে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে তাল বীজ সংগ্রহ করেন বপনের জন্য। গ্রামের লোকজন নিজেরা তালবীজ রোপণ করার পাশপাশি যুব ও স্বেচ্ছাসেবকদের দেওয়ার জন্য তাল ও খেজুর বীজ সংরক্ষণ করেন। এসব সংঘবন্ধ যুবদের গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থীরাও তাল ও খেজুর বীজ রোপণে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করেন। এলাকার প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় বর্তমানে বৃক্ষরোপণ একটা সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। ফলে এলাকায় দেখা যায়, রাস্তার পাশে বাড়ির আনাচে কানাচে ও জমির আইলে তাল গাছের চারা। স্বেচ্ছাসেবকদের উৎসাহের জায়গা হলো রাস্তার পাশে তাল গাছ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে হরিরামপুরের বিভিন্ন গ্রামের যুবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে তৈরি হয়েছে একটি শক্তিশালী নেটওর্য়াক। যা এলাকার বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় তথা শিক্ষা বিশেষেত নারী শিক্ষা, চরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক প্রথার বিস্তার রোধ, প্রাকৃুতিক সম্পদ তথা, পাখি রক্ষা, এলাকা উপযোগি বৈচিত্র্যময় বৃক্ষ সুরক্ষা, এলাকা উপযোগি বৈচিত্র্যময় ফসলের চাষসহ স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা, মাদকের বিস্তার রোধসহ প্রাকৃতকি ও সামাজিক সংকট মোকাবেলায় এলাকার যুব সমাজের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এইসব সংকট মোকাবেরায় বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসচেতনতা, নারীর সামাজিক নিরাপত্তা, সুরক্ষিত হচ্ছে প্রান্তিক পরিবারের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, সরকারি সেবা পরিসেবায় গ্রামের প্রান্তিক পরিবাররের অংশিদারিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজেদের আদান প্রদানের সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার ভেতর দিয়ে সুদৃঢ় হচ্ছে সামাজিক বন্ধন, বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রাকৃতিক ও সামাজিক সংকট মোকাবেলার সক্ষমতা।


বিগত প্রায় এক যুগ এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কর্মকৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে সহায়কের ভূমিকা পালন করছে বারসিক। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকার যুব সমাজ, পেশাজীবী আগ্রহী জগোষ্ঠীর এলাকার প্রাকৃতিক ও সমাজিক সংকট মোকাবেলায় নিজেরা সংগঠিত হচ্ছে গ্রহণ করছেন নানাবিদ উদ্যোগ এবং সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে সেসব কর্মপ্রচেষ্টা। এই কর্মপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, সরকারি সেবাদানদানকারী প্রতিষ্ঠান ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি হয়েছে এক সুদৃঢ় সামাজিক বন্ধন। এই সামাজিক বন্ধনই এলাকার প্রাকৃতিক ও সামাজিক সংকট ম্কোাবেলায় এক স্থায়িত্বশীল ক্ষেত্র।

happy wheels 2

Comments