“মেলে” ও কর্মসংস্থান: প্রেক্ষিত নারীর ক্ষমতায়ন

:: বারসিক কয়রা খুলনা থেকে ফিরে শাহীন ইসলাম ও মফিজুর রহমান

Untitledনারী। প্রতিদিন প্রতিটি অবস্থানেই ঝুঁকির মধ্যে অনবরত বসবাস যার। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে আরো একটু বেশি পিছিয়ে পড়া অংশের নাম নারী। দুর্যোগকালীন সময়ে আক্রান্ত মানুষ এর ভিড়ে আরো বেশি মাত্রায় আক্রান্ত যে অংশ- তাঁরা নারী। সামাজিক ও পারিবারিক নির্যাতনের প্রধান শিকার নারী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নারী। অথচ নারী এবং পুরুষের পারস্পরিক সহাবস্থানই জন্ম দেয় আমাদের সামাজিক কাঠামো। পৃথিবীর সমগ্র মানব বসতির প্রায় অর্ধেক নারী। ফলে নারীর অবস্থার উন্নয়ন বা নারীর ক্ষমতায়ন ব্যতিত কোন সমাজ বা জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর নারীর উন্নয়ন বা ক্ষমতায়ন এর প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো নারীর আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠা। আত্মনির্ভরশীলতা নারীকে ক্ষমতায়িত করে। উপকূলীয় অঞ্চল কয়রায় নারীদের সামনে নারী ক্ষমতায়নের সেই সুযোগকে মেলে ধরেছে “মেলে” ঘাস।

প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগ বিপন্ন একটি জনপদ বাংলাদেশের উপকূলীয় সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা। ৭টি ইউনিয়ন আর ১২০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত উপকূলীয় এ উপজেলায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষের বসবাস। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই সংগ্রাম করে বেঁচে আছে এ জনপদের মানুষেরা। বিশেষত সিডর ও আইলা এই এলাকার মানুষের জীবর মানের অবনমন ঘটিয়েছে অনেকখানি। কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই অবস্থান থেকে পেশাভিত্তিক জীবন-জীবিকা পূনঃগঠনে কয়রা জনপদ এর বাসিন্দারা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই প্রচেষ্টার পথেই নারীদের পাশে পরম বন্ধু হিসেবে ধরা দিয়েছে “মেলে ঘাস”।

“মেলে” ঘাস এক ধরনের ঘাস জাতীয় প্রাকৃতিক উদ্ভিদ। বছরের কার্তিক, অগ্রহায়ন ও পৌষ মাসে মেলে “মেলে” ঘাসের দেখা। তারপর এই “মেলে” ঘাস কেটে রোদে শুকিয়ে মাদুর তৈরির জন্য মজুদ করা হয়। সারাবছর ধরে নারীরা তাঁদের নৈমিত্তিক কাজের সাথে সাথে সময় বের করে এই মজুদ করা শুকনো “মেলে” ঘাস দিয়ে তৈরি করেন মাদুর, যা তাঁদের পারিবারিক আর্থিক চাহিদার যোগান দেয় বছরজুড়ে।

মেলে নোনা সহনশীল উদ্ভিদ। নদীর চরে আপনা থেকেই জন্মে এই ঘাস। তবে শুধু আপনজালা ঘাসের উপর নির্ভর করে থাকতে নারাজ এই জনপদের মানুষ। তাই কয়রা অঞ্চলে কম বেশি মেলে ঘাসের চাষ করা হয়। একটি মেলের গোছায় প্রায় ১০০ থেকে ১৫০টি মেলে গাছ জন্ম নেয়। মেলে ঘাসের চাষকে লাভজনক মনে করছেন মেলে চাষের সাথে জড়িত মানুষেরা। এক বিঘা জমিতে চাষ করলে বছরে প্রায় ২০,০০০ টাকার মেলে বিক্রি করা যায়। আর মাদুর বানিয়ে বিক্রি করলে লাভের পরিমাণটা আরো বেশি।

Unti্‌ledনারীরা ঘরে বসে মেলে থেকে মাদুর তৈরি করে সহজে আয় করতে পারেন। দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি একজন নারী সপ্তাহে ২ থেকে ৩ টি মাদুর তৈরি করতে পারেন। কয়রা উপজেলার আমাদি ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা ও চন্ডিপুর গ্রামের প্রায় ৪৬ জন প্রান্তিক নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে মেলে ঘাস। উভয় গ্রামের নারীরা দল গঠন করে কাজটি ধরে রেখেছেন। তাঁরা সপ্তাহে শুক্রবার ও মঙ্গলবার আমাদির হাটে মাদুর বিক্রি করেন। এক একজন নারী বছরে মাদুর বুনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। ফলে তাঁদের মধ্যে একধরনের আত্মনির্ভরশীলতা জন্ম নিয়েছে। মাদুর বিক্রির টাকায় সংসারের বিভিন্ন চাহিদা তাঁরা নিজেরাই পূরণ করতে পারছেন। পরিবারের বাজার, সন্তানের লেখাপড়া, পোষাক ইত্যাদি এর জন্য তাঁদেরকে আর আগের মত সবসময় স্বামী বা পরিবারের কোন পুরুষ সদস্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় না। “মেলে’ আমার পরিবারের খোরাকি (খাবার) যুগায়। ৫/৬ বছর যাবত আমার পনি দুই বিঘা জমির মধ্যে ৬ কাঠা জমিতে ‘মেলে’ চাষ করি। আমি আজীবন ‘মেলে’ ধরে রাখবো। বছরে ৭ হাজার টাকার ‘মেলে’ বিক্রি করি এবং নিজের জন্য রেখে দেয়। ‘মেলে’ চাষে খরচ কম ও তেমন দেখাশুনা করার দরকার হয় না। আমি ‘মেলে’ বিক্রির টাকায় পরিবারের সারা বছরের খাবার মজুদ করে রাখি। ১০ বছর আগে আমার স্বামী মারা যায়। সেই থেকে নিজে জোন মজুরি দিয়ে মাছ-কাঁকড়া ধরে ও মাদুর বুনে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।” নিজের অনুভূতির কথা এভাবে তুলে ধরেন আমাদি ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের কুসুম রানী।

পারিবারিক চাহিদা পূরণে সক্ষমতা অর্জন এবং আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবার কারণে পরিবারে এই নারীদের মতামতকে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শুধু পরিবারেই নয়, সমাজেও এই সকল নারীর সম্মান বেড়েছে। নারী ক্ষমতায়ন এর প্রক্রিয়ায় একধাপ এগিয়ে গিয়েছে এই সকল নারীরা। এই পরিবর্তনকে তাঁদের সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করছেন। বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের শিখা রানী সরকার বলেন, “পরিবারে আমাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়। নারীর সম্মান বেড়েছে। সন্তানের লেখাপড়া ও নিজেদের সখ ও সম্পদ করতে পারছি”।

উল্লেখ্য যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর এবং আইলা কয়রা উপজেলার কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রেক্ষাপটে কৃষি এবং পেশাভিত্তিক জীবন-জীবিকা পূনঃগঠনে বারসিক কয়রা জনপদ পর্যবেক্ষণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে আলোচনা করে প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১০ সালে বারসিক কয়রার আমাদি ইউনিয়নে প্রকল্প অফিস নিয়ে জনগোষ্ঠীর সাথে অবস্থান করে কাজ শুরু করে এবং ২০১৩ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা, চন্ডিপুর, খিরোল, ভান্ডারপোল, দশবাড়িয়া ও খেওনা গ্রামের স্থানীয়দের পরিকল্পনা অনুযায়ী নদীর চর বনায়ন, নারীর কর্মসংস্থানে, সুপেয় পানির উৎস সংরক্ষণ, কৃষি ও বন নির্ভর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তীতে বারসিক শ্যামনগর রিসোর্স সেন্টার থেকে কোন প্রকার প্রকল্প ছাড়াই জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। উপকূলীয় নারীর লোকায়ত জ্ঞাণ ও তাদের শিল্পকমর্কে শ্রদ্ধা, সম্মান ও স্বীকৃতি হিসেবে বারসিক থেকে ২০১১ সালে কয়রা উপজেলার আমাদি ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা ও চন্ডিপুর গ্রামের মোট ৪৬ জন প্রান্তিক নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে “মেলে সম্মাননা” দেওয়া হয়।

happy wheels 2

Comments