ছট্ পূজায় আনন্দে মাতল চাটমোহরের হরিজন সম্প্রদায়

চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
কাসর ঢাক ঢোল বাজাতে বাজাতে চাটমোহরের হরিজন সম্প্রদায়ের এক দল শিশু কিশোর নারী পুরুষ আনন্দ করতে করতে চাটমোহর পুরাতন বাজার এলাকা থেকে পৌর সদরের প্রধান সড়ক হয়ে পূর্ব দিকে হাটছিল দ্রুত গতিতে। কারো হাতে মঙ্গল প্রদীপ, কারো মাথায় লাল শালু কাপরে ঢাকা পূজার অর্ঘ বোঝাই ডালি। কোথায় যাচ্ছ জানতে চাইলে হরিজন সম্প্রদায়ের এক যুবক জানান আজ ছট্ পূজা। কাজী পারার একটি পুকুরে এ পূজার বাঁকী আনুষ্ঠাননিকতা সারা হবে। ততক্ষণে শিশু কিশোর নারী পুরুষের দলটি অনেক দুর এগিয়ে গেছে। হরিজন যুবকটিকে গাড়িতে তুলে চলে যাই কাজীপাড়ার নির্ধারিত পুকুর পারে।

sot puja-4
চাটমোহর শাহী মসজিদ থেকে একটু দক্ষিণেই এ পুকুরের অবস্থান। পুকুরটির পশ্চিম পারে আরেকটি মসজিদ। ছট্ পূজা উপলক্ষে প্রাচীন এ পুকুরটির শান বাধানো ঘাট সাজানো হয়েছে। এ সাজে খুব বেশি জৌলুশ না থাকলেও হাওয়ায় ফুলোনা হরেক রঙের বেলুন গুলো যখন উড়ছিল তা উপস্থিত শিশু কিশোর দশনার্থীর মনকে দোলা দিয়ে যাচ্ছিল। উত্তরের রাস্তায় কম দামী স্বল্প আওয়াজের বাজী ফোটাচ্ছিল শিশু কিশোরেরা। সূর্য ডোবার খুব বেশি দেরি নেই তখন। মাগরিবের নামাজ আদায় করতে অনেক মুসুল্লী ততক্ষণে মসজিদে চলে এসেছেন। তাদের অনেকেই পুকুর পারে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন ছট্ পূজার আনুষ্ঠানিকতা।

sot puja-5
ডালি থেকে পূজার অর্ঘ বোঝাই কুলো গুলো নামিয়ে পাশাপাশি রাখছিলেন খোকন বাঁশ ফোর নামক এক যুবক। লেবু, কলা, নাড়কেল, মুলা, কচু, পেয়ারা, বরবটি, বেল, জাম্বুরা, আদা, কাঁচা হলুদ, আখ, আপেল, কলা, কদবেল, কমলা, কপি, খিরা, শসা, লাড্ডু, কদমা, মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে, পালং শাক, পান, সুপারি, চাউলের আটার হরেক রকমের পিঠা, হলুদ পাতা, আম পাতা আরো কতো কি। এসবই বিসর্জন করা হবে ঊশ^রের উদ্দেশ্যে। উপলক্ষ একটাই। ইশ^র যেন মনো বাসনা পূরণ করেন। জ¦ালানো হলো মঙ্গল প্রদীপ।

লিলিয়া বাঁশফোর ও স্মৃতি বাঁশফোর এ পূজা করছেন। অন্যরা উপভোগ করছেন পূজার আনন্দ। পুকুরে কোমড় পানিতে দাঁড়িয়ে বিদায়ী সূর্যের দিকে লিলিয়া বাঁশফোর ও স্মৃতি বাঁশফোর তাদের মাথা অবনত করে সূর্য দেবতাকে জানাচ্ছেন শ্রদ্ধা। জনৈক মহিলা ও খোকন বাঁশফোর তাদের এগিয়ে দিচ্ছেন পূজার অন্যান্য সামগ্রী। এসময় ছোট্র শহর চাটমোহর রূপ নেয় সম্প্রীতির বড় মেলবন্ধনে। সূর্যাস্তের সময় আপাতত এ দিনের মতো শেষ হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা।

sot pujaaaaaaaaaaaa-1
মদন কুমার বাঁশফোড়, খোঁকন বাঁশফোর, প্রীতম ও মুক্তা রানীর সাথে আলাপ কালে জানা যায়, কালীপূজার ছয় দিন পরে তারা এ পূজার আয়োজন করে থাকেন। যারা মানসা করেন তারাই এ পূজা করেন। সম্প্রদায়ের অন্যরা তাদের সহায়তা করেন। এ পূজায় তারা মনোবাসনা পূরণের জন্য ঈশ^রের কৃপা প্রার্থনা করেন। কালীপূজার ছয়দিন পর বাড়িতে পূজা দিয়ে তারা কাজীপারার এ পুকুরে আসেন। সূর্যাস্তের ঠিক আগে এ পূজাটি করা হয়। পরদিন ভোরে আবার একই স্থানে সূর্য উদিত হবার আগে তারা বাকি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন। সূর্য ওঠার সাথে সাথে পূজার কাজ শেষ করতে হয়। পূজার কিছু উপকরণ পানিতে বিসর্জন দেয়া হয়। কিছু উপকরণ ফিরিয়ে নিয়ে প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। যিনি এ পূজা করেন তার আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে প্রয়োজনে চাঁদা হারী তুলে পূজার্থীকে পূজা করতে সহায়তা করেন অন্যরা। তারা আরো জানান, সাধারণত বাঁশফোর মারোয়ারী ও ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ এ পূজাটি করে থাকে। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে ব্যাপক আয়োজনে এ পূজা করা হয় বলেও জানান তারা।

কথায় বলে বিশ্বাসে মিলায় হরি তর্কে বহুদূর। ধৃ অর্থ ধারণ করা। এক একজন ব্যক্তি এক একটি ধর্ম মত পালন করেন। বিশ্বাস করেন। ব্যবহারিক ধর্ম চেতনায় বিশ্বাসী হিন্দু ধর্ম একাধিক প্রথা সংস্কার ও আদর্শে বিশ্বাসী। সম্প্রদায় ভেদে এ আদর্শের তারতম্য দেখা যায়। অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ ছট্ পূজা পালন না করলেও অনেক সম্প্রদায়ের মানুষ এ পূজা করেন। কর্মফলের ভিত্তিতে পূনর্জন্মবাদে বিশ্বাসী হওয়ায় কিছু সংখ্যক মানুষ নাস্তিকতার দিকে ধাবিত হলেও অধিকাংশ মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রচলিত ধর্মমতে বিশ্বাস স্থাপন করেন; সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। তেমনিভাবে লিলিয়া এবং স্মৃতিরা মোক্ষলাভ ও মনোবাসনা পূরণে যে পূজাগুলো করে থাকেন তার মধ্যে একটি হলো ষট পূজা।

happy wheels 2

Comments