প্রাণ ফিরে পেল মৃতপ্রায় ধলেশ্বরী
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ধলেশ্বরী, বাংলাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত একটি নদী। যমুনার বৃহত্তম শাখা ধলেশ্বরী। এর দৈর্ঘ্য ১৬৮ কিলোমিটার। সুদূর অতীত থেকে এ নদী মানিকগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়েই প্রবাহমান। অষ্টাদশ শতকে এ নদীর গতিধারা ছিল পশ্চিম থেকে পূর্বাভিমূখী। কিন্তু উনিশ শতকে এই নদীর গতিধারা ও প্রবাহে ভিন্নতা প্রতীয়মান হয়। বিশেষত আদি ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবাহ বর্তমান যমুনা খাতে প্রবাহিত হবার পর ধলেশ্বরী পুরোনো পশ্চিম পূর্বমূখী গতিপথ ত্যাগ করে ক্রমশ উত্তর এবং উত্তর-দক্ষিণমুখী হয় এবং বর্তমানে তার উৎসমুখ থেকে দক্ষিণাভিমুখী হয়ে মানিকগঞ্জে প্রবেশ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যসূত্র মতে, মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ধলেশ্বরী, পুরাতন ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা ও ইছামতি নামে চারটি নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১ কিলোমিটার। এছাড়াও গাজীখালী নামে আরও একটি নদী রয়েছে। ধলেশ্বরী নদী ঘিওর উপজেলার জাবরা থেকে শুরু করে সাটুরিয়ার তিল্লী, বরাইদ হয়ে জাগীরের ভেতর দিয়ে সিঙ্গাইরের শেষ মাথা পর্যন্ত মিশেছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। পুুরাতন ধলেশ্বরী নদীটি দৌলতপুরের মূল যমুনা থেকে শুরু হয়ে ঘিওরের জাবরায় এসে শেষ হয়। এর দৈর্ঘ্য ২৬ কিলোমিটার।

বারসিক ২০০৭ সাল থেকে মানিকগঞ্জে সুপেয় পানির সংকট নিরসন এবং মানিকগঞ্জের প্রধান নদীগুলোর নাব্যতা রক্ষার লক্ষ্যে ক্যাম্পেইন, অনুষ্ঠান, সংবাদ সম্মেলন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আলোচনা ও মতবিনিময় সভা প্রভৃতি কার্যক্রম সম্পন্ন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ধলেশ্বরী নদীর সাথে সম্পর্কিত নদী পাড়ের জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, সরকারি বেসরকারি ও সকল জনউদ্যোগে সংকটাপন্ন ধলেশ্বরী নদীর সংকট কাটিয়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বস্তরের জনগণের নিজস্ব অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে বারসিক কাজ করেছে। যেমন-নদী রক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি ও নদী রক্ষায় জনমত গঠনের লক্ষ্যে নিয়মিত জনসচেতনতামূলক জনসমাবেশ আয়োজন, পোস্টার, প্রকাশনা, হ্যান্ডবিল ও লিফলেট বিতরণ, জনসমাগমপূর্ণ স্থানে বিলবোর্ড প্রদানের মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছে।
বছর তিরিশ আগেও ধলেশ্বরী নদী ছিলো যৌবনা নদী। ধলেশ্বরীর বুকে নৌকা বেয়ে জাল টেনে শতরকম মাছের সন্ধান পেত রাজবংশীরা। এই নদীর পানি মেটাতো তাদের তৃষ্ণা আর দৈনন্দিন গৃহস্থালী কাজের পানির চাহিদা। কিন্তু সেই ধলেশ্বরী নদী আজ আর নদী নেই। কেউ কেউ অবৈধভাবে নদী দখল করে সেখানে বসতি গড়ে তুলেছে। অনেকেই নদী ভরাট করে ফসলের আবাদ করছে। ফলে নদীতে পানি আসতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে ভাটি এলাকার লোকজন পানি পাচ্ছেনা। পানির অভাবে গোসল করা, গরু-ছাগল ঝাপানো, কৃষি কাজ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন অনেক ক্ষেত্রেই তারা সমস্যার সন্মূুখীন হচ্ছে। এই সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে একাধিকবার নদী সংলগ্ন এলাকাবাসীর সাথে আলোচনা সভা ও মতবিনিময় করা হয়।

২০১৩ সালে বারসিক’র সহযোগিতায় ধলেশ্বরী নদী সংলগ্ন এলাকাবাসী, ধলেশ^রী নদীর ফলে প্রভাবিত ১২টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে বারসিক নদী বিষয়ে কাজ করার ফলে বারসিককে মানিকগঞ্জ জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। সেই সাথে নদী রক্ষায় বারসিক’র কাজ করার স্বীকৃতি স্বরূপ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সদর এবং জেলা প্রশাসন মানিকগঞ্জ প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেছেন।
ধলেশ^রী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি গঠন করার পর থেকে বারসিক, ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি ও মিডিয়া কর্মীদের সমন্বয়ে ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখ ও চরতিল্লী, জাগীর ব্রীজ সংলগ্ন এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয় একাধিকবার। জাগীর ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গনে গণসমাবেশ ও সংহতি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে বারসিক, ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি, বাপা, পবা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও এই কাজের ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসক, মাননীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ধলেশ্বরী নদীর উৎসমুখ তিল্লীমুখ পরিদর্শন করেন। এরপর জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এর সভাকক্ষে ধলেশ্বরী নদী রক্ষা, নদীর অবৈধ দখল প্রতিরোধ, পানি দূষণ ও স্বাভাবিক গতি প্রবাহের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করা হয় এবং কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়।

দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফলে (২০১৩- ২০১৯) আজ আন্দোলন সফল হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী নদীর অবৈধ দখল ও দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সেই সাথে মহামান্য হাইকোর্ট নদী একটি জীবন্ত সত্ত¡া হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ধলেশ^রী নদী খননের জন্য ১০০ কোটি টাকা বাজেদ বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত পহেলা নভেম্বর ২০১৯ ধলেশ্বরী নদী খননের আনুষ্ঠানিকভাবে শুভ উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আলহাজ¦ জাহিদ মালেক স্বপন, এমপি। মানিকগঞ্জ জেলার ধলেশ^রী নদীর তীরবর্তী জাগীর ব্রীজের পাশে এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বহু সভা, সমাবেশ আন্দোলনের পর ধলেশ^রী নদী পুনঃখননের স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। সেইসাথে পূরণ হয়েছে ধলেশ^রী নদী পাড়ের মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি।

ধলেশ^রী নদী পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সেইসাথে ধন্যবাদ জানাচ্ছি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয়, জেলা প্রশাসক মহোদয়, মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগ, মিডিয়াকর্মীসহ যারা এই আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের সবাইকে।
নদী একটি জীবন্ত সত্ত¡া। নদীরও রয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার। যে কেউ চাইলেই তাকে দখল, দূষণ করতে পারবে না। আসুন নদীর এই অধিকার রক্ষায় আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হই।