আমার সম্পদ হারিয়ে গেছে

সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে বিধান মধু
‘দিনটি ছিলো ১০ নভেম্বর। সকলের মুখে মুখে শুনি যে, আমাদের এলাকা দিয়ে ঘূর্ণিঝড় আসছে। সবাই যেন সাবধানে থাকি। আমিও সাবধানে থাকার চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে রাত হতে থাকলো আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ করে অনেক রাতের মধ্যে ঠামমা আমাকে ডাকতে শুরু করলো ‘ওঠ ওঠ’। আমি ঘুমের মধ্যে বললাম যে কেন কি হচ্ছে। তখন ঠামমা বললো, ‘আমাদের ঘর যেন কেমন দুলছে এখনই বের হতে হবে। এ সময় আমরা দুই বোন, বাবা, মা এবং ঠাকুমা নিজেদের ঘরের মধ্যেই ছিলাম। ভেবেছিলাম তেমন কিছুই হবে না। কিন্তু রাত হওয়ার সাথে সাথে ঝড়ের গতিবেগ বাড়তে থাকে আমাদের চিন্তা ও বাড়তে থাকে। তাড়াতাড়ি করে ঘরের সবকিছু গুছিয়ে নিলাম।’ কথাগুলো বলেছিল শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বিলআটি গ্রামের কৃষক অশোক কুমার মন্ডলে ৭ম শ্রেণী পড়–য়া ছাত্রী শ্রাবন্তী মন্ডল।


সেদিনকার ঝড়ের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে শ্রাবন্তী বলে, ‘ঠাকুমা বারবার করে বলেছিলো চল সবাই আশেপাশের ভালো কোন বাড়িতে আশ্রয় নেই। কিন্তু নিজেদের ঘর ছেড়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। অবশেষে অন্য কোন উপায় না দেখে ঝড়ের মধ্যেই পাশের বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হলাম। কিছুদূর যেতেই পিছনে ফিরে দেখি হুড়মুড় করে ঘরটি পড়ে গেল। কোন রকমে আমার প্রাণে বেঁচে গেলাম। পাশের বাড়ি গিয়ে রাত্রিযাপন করে সকালে যখন বাড়ি ফিরলাম এসে দেখলাম ঘরের সব কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। যার মধ্যে আমার অতি যতœ করে রাখা দু’বোনের বইগুলো ঝড়ে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। সামনেই ছিল আমার ফাইনাল পরীক্ষা। খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, তখন তো সবারই পরীক্ষা। তাই পাশের বাড়ির একজন আমার ক্লাসে পড়ত তার বই দুজনে ভাগাভাগি করে পরীক্ষা দিয়ে এবছর অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছি।


শ্রবন্তী আরও বলে, ‘বাবার আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে কিছু বই কিনেছি এবং কিছু বই স্কুল থেকে পেয়েছি। অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। আমি স্কুল ছাড়া ও পাশ্ববর্তী কোচিং পড়ি। কষ্ট করে পড়াশুনা করার পাশাপাশি কোচিং এ যাওয়ার সময় বইগুলো হাতে নিয়ে যাওয়া আসা করতাম । আমি যেহেতু একজন শির্ক্ষাথী সেক্ষেত্রে আমার মা বাবার পরিবারের সবাইকে যেমন ভালোবাসতাম বন্ধু মনে করতাম আর এ বই গুলোকেও তেমন মনে করতাম। যেহেতু উপকূলীয় এলাকায় বাস করি সেহেতু আমরা জানি যে, আমাদের এলাকায় ছোট বড় নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সব সময় লেগেই থাকে। এটা আমি দেখেছি এবং বাবা মায়ের কাছ থেকে জেনেছি।’


শ্রাবন্তী বলতে থাকে, ‘আমি আইলার সময় ছোট ছিলাম কিছু কিছু মনে আছে। অনেকের দেখেছি ঘরবাড়ি, ঘের গাছপালা, স্কুল, জমিজমা বইপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমি সব সময় চিন্তা করি যেহেতু আমি একজন ছাত্র আমার বাবা মা অনেক কষ্ট করে বইগুলো কিনে দিয়েছে এগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করা দরকার। তাই তো কোন রকম কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে আমার বই ভালো জায়গার রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু ঝড়ে ঘরটি এভাবে পড়ে যাবে এবং সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে তা বুঝতে পারিনি ।


বর্তমানে শ্রাবন্তীরা চার বোন, মা, বাবা ও ঠাকুরমাসহ সংসারে মোট সাতজন নিয়ে বসবাস করে। দু’বোনের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। বর্তমানে শ্রাবন্তী মন্ডল তপোবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী, অন্য বোন জয়ন্তী মন্ডল ডিগ্রী প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বাবা একজন কৃষক। বসতভিটাটুকু ছাড়া জমিজমা নেই বললেই চলে। সংসারের ভরণপোষণ দুই মেয়ের পরশুনাসহ কোন রকমে চলে তাদের সংসার। সম্প্রতি সময়ে ইনিয়নের চেয়্যারম্যান বাড়িটি পরিদর্শনে এসেছিলেন। সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি দেখে প্রয়োজনীয় সহায়তা করার আশ্বাস দেন। আশা করি আশ্বাস অনুযায়ী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শ্রাবন্তীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবেন।

happy wheels 2

Comments