বাড়ছে পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার

সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল

গ্রামীণ জনজীবনে চুলার ব্যবহার অপরিসীম। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নানা রকম চুলার ব্যবহার দেখা যায়। সাধারণ বা প্রচলিত চুলায় জ্বালানি খরচ বেশি, রান্না হতে বেশি সময় লাগে। রান্নাঘরে ধোঁয়া, কালি ও ঝুল হয় এবং হাঁড়িপাতিল বেশি ময়লা হয়। চুলা ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্যহানি ঘটে এবং রান্নাঘরের পরিবেশ দূষিত হয়। তুলনামুলক কার্বন নিসরণ বেশি হয়। গাছপালা ও বৃক্ষ সম্পদ কমে যাওয়াতে বাংলাদেশের সর্বত্র জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমাদের দেশের গ্রাম বাংলার মানুষেরা কাঠ, খড়, নাড়া, গুল, লতা, পাতা ও ঘাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু বর্তমানে প্রাকৃতিক বিপর্যায়ের কারণে এ সকল জ্বালানির উপকরণ কমে দিনকে দিন। এজন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী স্বল্প পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহারে ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পড়ে। যে কারণে গ্রামীণ নারীরা জ্বালানি সংকট নিরসনে নানা ধরনের জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলার ব্যবহারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। উপকূলীয় এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কিছু কিছু পরিবারের নারীরা জ¦ালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার করছেন।

উপকূলীয় শ্যামনগর এলাকার আটুলিয়া ইউনিয়নের তালবাড়িয়া গ্রামের ময়না রানী (৬২) জ¦ালানী সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব চুলার একজন শ্রেষ্ঠ কারিগর। বিগত ২০ বছর যাবৎ তিনি এ চুলা তৈরি করেছেন সমগ্র উপকূলীয় এলাকায়। তাঁর কাছ থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে একজন অল্পনা রানী। একই উপজেলার ঈশ^রীপুর ইউনিয়নের অল্পনা রানী বর্তমানে এই চুলার ব্যবহার বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্থানীয় গ্রামীণ নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

বারসিক ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় কর্মএলাকায় বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা শক্তিসালীকরণ (পরিবেশ) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দুই উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ১৬০০ দরিদ্র পরিবারকে জলবায়ু সহিষ্ণু ও বহুমূখী আয় বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জ্ঞান ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে দক্ষতা বৃদ্ধি করা, সরকারী বেসরকারী সেবাসমূহ, তথ্য ও সম্পদে প্রবেশাধিকার এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা, জলবায়ু ন্যায্যতা ও অধিকার রক্ষায় আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের নীতি প্রণেতা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপ এসকল লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে প্রকল্প চলমান রয়েছে।

পরিবেশ প্রকল্পের ৮টি ইউনিয়নের কমিউনিটি সিএসও সদস্যদের মাঝে জ¦ালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব চুলার তৈরি ও ব্যবহার বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষক অল্পনা রানী মিস্ত্রী নিজে হাতেকলমে চুলা তৈরি শিখিয়ে দেন সাধারণ চুলা ও এই পরিবেশবান্ধব চুলার পার্থক্য আলোচনা ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। এসময় প্রশিক্ষক অল্পনা রানী মিস্ত্রী বলেন, “এই চুলায় খড়, কুটো, নাড়া, ঘুটে, কাঠ, ঘাস, মশাল, কাঠের গুড়া, তুষ, বুলেন, গাছের লতাপাতা ও বুড়ে ইত্যাদি জ্বালানি ব্যবহার করা যায়। একটি চুলায় একসাথে তিনটি মুখ থাকে অর্থাৎ তিনটি হাড়ি/পাত্র একসাথে ব্যবহার করা যায়। এই চুলায় একদিকে যেমন কম জ্বালানি লাগে, তেমনি অল্প সময়ে রান্না করা যায় এবং কোন ধোঁয়া তুলনামুলক কম হয়, ফলে ঘরের মধ্যে কোন কালি পড়ে না। পরিবেশবান্ধব এ চুলা বানাতে খরচ নেই বললেই চলে।”

অল্পনা রানীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজের রান্না ঘরে চুলা তৈরি করেছেন এমন একজন নারী বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের যমুনা রানী বলেন, ‘আগে আমি সাধারণ চুলা ব্যবহার করতাম, এখন তার উদ্ভাবিত চুলা ব্যবহার করি। এই পরিবেশবান্ধব চুলায় স্বল্প সময়ে রান্না করা যায়। কেননা এর কোন আচ/জ্বাল বাইরে বের হয় না এ কারণে জ্বালানি অন্য চুলার তুলনায় কম লাগে, ধোঁয়া পাইপ দিয়ে বাইরে চলে যায় ফলে ঘরের মধ্যে কোন কালি পড়ে না এবং হাড়ি কড়াতে ও কালি কম পড়ে।

কাদামাটির সংমিশ্রণে তৈরি এ চুলা খুব সহজেই তৈরি করা যায় বলেই এটার প্রতি স্থানীয় গ্রামীণ নারীদের আগ্রহ বেড়ে যায়। যে কারণে এই চুলা ব্যবহারে মাত্রা বেড়ে চলেছে দিনকে দিন। অল্পনা রানীর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পেয়ে শ্যামনগরের অনেক পরিবার এই চুলা ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ৮টি কমিউনিটি সিএসও সদস্যরা এই পরিবেশবান্ধব চুলার প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেদের ৮০টি সিএসও দলের ১৬০০টি পরিবারের নারীদের এই প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন। এই প্রশিক্ষণ পেয়ে বারসিক পরিবেশ প্রকল্পের ৪৬৪টি পরিবার জ¦ালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব এই চুলা ব্যবহার করছে।

এই চুলা ব্যবহারে একদিকে যেমন গ্রামীণ নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে জ¦ালানি সাশ্রয় হচ্ছে, অপরদিকে পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার বৃদ্ধিতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখছে।

happy wheels 2

Comments