স্বপ্ন পূরণে যাযাবর জীবন

কলমাকান্দা নেত্রকোনা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা

“স্বপ্ন দেখছিলাম বিশ হাজার টাকা মাসে আয় করতে পারলে সংসারটা ভালো কইরা চালাইতে পারমু। আমার সেই স্বপ্ন অনেক আগেই পূরণ হইছে। এখন মাসে প্রায় লাখের উপরে আয় করি। কিন্তু আরেকটি স্বপ্ন পূরণ হইতে এখনো বাকি। আমার তিন (২ ছেলে ১ মেয়ে) সন্তান সবাইরে শিক্ষিত করাইয়া ভালো চাকরি করাইতে চাই। সবাই ভালো চাকরি কইরা ভালোভাবে থাকলে আমার জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ হইব। আর তহনই আমি এই যাযাবর জীবন থেইকা ঘরে ফিরমু।” কথাগুলো নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের শ্রীরামখিলা গ্রামের হাঁস খামারী রেজাউল খানের। যিনি জীবন ও জীবিকার তাগিদে বছরের অধিকাংশ সময় হাঁস নিয়ে ঘুরে বেড়ান হাওরের বিভিন্ন অঞ্চল।

মাত্র ১২ বছর বয়সে তার মুক্তিযোদ্ধা পিতা মারা গেলে তখন থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয় রেজাউলের। তখন সংসারের আর্থিক অবস্থা খুবই দূর্বল ছিল। পড়াশুনায় প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও মাত্র ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করতে পেরেছেন। আর এই সময়ই তার ছোট দুই ভাই বোনকে পড়ানোর গুরু দায়িত্বও ছিল তার কাঁধে। অনেক সময় ভাই বোনদের ঠিকমত খাতা, কলম ও পরীক্ষা ফি পর্যন্ত দিতে পারেনি। কিন্তু ভাই বোনকে শিক্ষিত করার প্রচন্ড ইচ্ছা তার। ভাই বোনেরও পড়াশুনায় আগ্রহ ছিল প্রচন্ড। তাই তাদের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার ভালোভাবে পরিচালনা করার জন্য তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন মাসে ২০ হাজার টাকা আয় করার। তাই দিনমজুর ও অন্যান্য কাজের পাশাপাশি ১৬টি হাঁস দিয়ে তিনি বাড়তি অর্থ উপার্জনের চেষ্টা শুরু করেন। তার এই উদ্যোগ ও উৎসাহ দেখে দূুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর ও দূর্গাপুর ডিএসকে সংস্থা হতে বিভিন্ন সময় দূর্গাপুর ও ময়মনসিংহে হাঁস পালনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার সুযোগ করে দেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে তিনি হাঁসের খামার গড়ার সাহস লাভ করেন। সেখান থেকেই শুরু তার জীবনের নতুন সংগ্রামের। কিন্তু হাঁস পালনের জন্য তাকে বেছে নিতে হয় যাযাবর জীবন। কারণ যেখানে পানি সেখানেই তাকে হাঁস নিয়ে ছুটতে হয়।

Exif_JPEG_420

Exif_JPEG_420

তার স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী হলো ১৫০০টি হাঁস ও দু’জন কর্মচারী। তার বাড়ী দূর্গাপুরের পাহাড়ি এলাকায় কিন্তু এতগুলো হাঁসের জন্য প্রয়োজন খাল, বিল, নদী, নালা ও হাওর অঞ্চলের যেখানে পর্যাপ্ত পানি থাকে সারাবছর। তিনি বাড়িতে থাকতে পারেন মাত্র ৩ (বৈশাখ-আশ্বিন) মাস। কারণ এই সময় এলাকায় ধানের জমি ও খাল, বিলে পর্যাপ্ত পানি থাকে। আশ্বিন মাসের পর পানি শুকাতে শুরু করলে আশ্বিন-অগ্রহায়ণ এই তিন মাস পর্যন্ত কলমাকান্দার বড় হাওরে অবস্থান করেন। অগ্রহায়ণ মাসে কলমাকান্দা বড় হাওরের পানি শুকাতে শুরু করলে পৌষ -চৈত্র এই তিন মাস তাহেরপুরের মাইট্টানি (মাটিয়ান) হাওরে অবস্থান করেন। এরপর পুনরায় আবার নিজ এলাকায়। এভাবে চক্রাকারে প্রতি তিন মাস পর পর তার অবস্থানের পরিবর্তন চলতে থাকে। এভাবে প্রখর রৌদ্র, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত, আফাল (ঢেউ), তুফানের সাথে সংগ্রাম করে হাওরে হাওরে ছুটে বেড়াচ্ছেন হাঁস নিয়ে। হাওরের মাঝখানেই একটু উচু জায়গাই অস্থায়ী দূর্বল ঘর তৈরি করে সেখানেই রাত্রি যাপন করেন। টিনের চুলা ও বৃষ্টির সময় স্টোব দিয়ে রান্না করেন। নৌকায় করে লোকালয়ে গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করেন। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কিছু ঔষধপত্র সঙ্গে রাখেন সবসময়। তার এই পথচলা দূর্যোগ ও ঝুকিপূর্ণ হলেও তার স্বপ্ন তাকে সাহস যোগায় এগিয়ে যাবার, পরিশ্রম করার।

শুরু ১৬টি হাঁস নিয়ে করলেও কয়েক বছরেই তার হাঁস বেড়ে হয়েছিল ৫০০০টি। কিন্তু পরিচর্যা করার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়ায় বর্তমানে ১৫০০টি হাঁস পালন করছেন। হাঁেসর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তার উপার্জনও বাড়তে থাকে। পরিবর্তন ঘটতে থাকে পরিবারের আর্থিক অবস্থারও। তাদের ছনের ঘরের পরিবর্তে এখন হাফ বিল্ডিং ঘর হয়েছে। নিজস্ব ৫০ কাঠা জমি ক্রয় করেছে। হাঁসের সুবিধার কথা ভেবে যাযাবর জীবনযাপন করায় কৃষি কাজ করার সুযোগ পান না। ছোট এক ভাই ও এক বোন মাস্টার্স পাশ করে ভালো চাকুরি করছেন। ছোট ভাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও ছোট বোন গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে অবস্থিত একটি বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক। দু’ ভাই বোন প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনই তাকে অভিভাবক ভাবেন এবং পিতার সমমর্যাদা দেয়। এখনও তারা তার উপর নির্ভরশীল যেকোন সিদ্ধান্তের জন্য। সামাজিকভাবেও এখন তারা অনেক মর্যাদাশীল জীবনযাপন করছেন। কিন্তু এখনও তার সব স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তার দুই ছেলে ও এক মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়ে ভালো চাকরি করানোর স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই তাড়নায় দীর্ঘ ২০ বছরের পেশা এখনও তিনি ধরে রেখেছেন।

Exif_JPEG_420

Exif_JPEG_420

তিনি বলেন, “পরিশ্রম করতে পারলে হাঁস পালন করা অত্যন্ত লাভজনক। তবে ভালো জাতের হাঁসের প্রয়োজন। কয়েক জাতের হাঁস আছে যেমন- খাকি, ক্যাম্বল, জিংদী, রানার সোদা (ইন্ডিয়ান), ক্যাসিও প্রভৃতি। তার মধ্যে খাকি জাতটি সব থেকে ভালো। ডিম বেশি দেয়। কিন্তু বর্তমানে এই জাতটি আর পান না বলে জিংদী জাতের হাঁস তিনি পালন করছেন। হাঁস খোয়ারে (ঘরে) রেখে পালন করলে ডিম কম দেয়। সব সময় পানিতে ছেড়ে রাখলে একটি হাঁস বছরে ৩০০টি ডিম দেয়”।

তিনি জানান, ১৫০০টি হাঁসের মধ্যে তিনি নিজের কাছে রেখেছেন ১০০০টি ও বাকি ৫০০টি হাঁস অন্য মধ্যনগরের রংচিতে আরেকজনের দায়িত্বে দিয়ে রেখেছেন। কারণ ১৫০০-২০০০টি হাঁসের উপরে হলে সঠিকভাবে পরিচর্যা করা যায় না। ফলে ডিম উৎপাদন কম হয়। তার নিজের কাছে থাকা ১০০০টি হাঁসের মধ্যে ৯০০টি হাঁস প্রতিদিন ডিম দেয়। ডিম প্রতি ৮ টাকা দরে বিক্রি হয়। বাজারে গিয়ে তাকে ডিম বিক্রি করতে হয় না। ক্রেতারাই তার কাছে গিয়ে ডিম ক্রয় করেন। ডিম থেকে অর্জিত আয় দিয়েই তিনি প্রতি মাসে দু’জন কর্মচারীরর জন্য ১৭,০০০ টাকা, পারিবারিক খরচ ও নিজেদের খাবার বাবদ ব্যয় করেন। তাছাড়া হাঁসের জন্য মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র ও আশ্বিন মাসে প্রতিদিন ৩ মণ করে ধান দিতে হয়। কারণ এই সময় হাওর থেকে হাঁস কম খাবার পায়। তাছাড়া সারাবছর ধরে হাঁস কলেরা ও প্লেগ রোগে আক্রান্ত হলেও ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে আক্রান্তের মাত্রা বেশি হয়ে যায়। এই সময় ডিটিটেন, রেনাগাত, এরাকট, টিয়ামলিন, সেলাইন জাতীয় ঔষধ বেশি পরিমাণে ক্রয় করতে হয়। হাওরে হাঁস চড়াতে হাওরের ইজারাদারদের জন্য হাওরের আয়তন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়। কলমাকান্দা বড় হাওরের ইজারাদাদের এক মাস হাঁস চড়ানোর জন্য তিনি একা ১০,০০০/- টাকা এবং তাহেরপুরের মাটিয়ান হাওরের জন্য ৫জন হাঁস খামারী মিলে ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা তিন মাস হাঁস চড়ানোর জন্য দিতে হয়।

তার স্বপ্ন পূরণ হতে এখনও বেশ কয়েক বছর লাগবে। বর্তমানে তার বড় ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী, মেয়ে দূর্গাপুর মহিলা কলেজে এইচএসসি ২য় বর্ষে এবং ২য় ছেলে দূর্গাপুর ডিগ্রি কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়াশুনা করছে। সন্তানদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখছেন তা পূরণের প্রতিক্ষায় হাঁস নিয়ে এখনও যাযাবর জীবন যাপন করছেন। সন্তানরা মানুষের মত মানুষ হলেই এই যাযাবর জীবনের অবসান ঘটাবেন তিনি।

happy wheels 2