“আমি জানি না খেয়ে থাকাটা কত কষ্টের”

নেত্রকোনা, কলমাকান্দা থেকে গুঞ্জন রেমা

“যহন আমার বয়স ৭ বসর তখন ৫ টাকার রোজে কাজ করসিলাম মাশের (মাছের আড়ত) আরতে” এ কথা দিয়েই শুরু হয় লাকী আক্তারের (২২) জীবন সংগ্রামের গল্প। নেত্রকোণা জেলার সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের মেয়ে লাকি আক্তার দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আজ সফল ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন। ২০০১ সালে দৈনিক ৫ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করেন মাছের আড়তে কিন্তু মালিকের সাথে বনিবনা না হওয়ায় নিজেই শুরু করেন হোটেল ব্যবসা। আজ তিনি কলমাকান্দা মায়ের দোয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট এর মালিক ।

কিন্ত তার জীবন চলার পথ এত সহজ-সরল ছিল না, যদিও জীবনের শুরুতে বাবা-মা ছোট ভাই ও বোনদের নিয়ে ভালোই দিন চলছিল তাদের। মাঝখানে পারিবারিক কিছু সমস্যার কারণে তার বাবা ও মায়ের সম্পর্কে ফাটল ধরলে তিনি চলে আসে ফুফুর বাড়ি কলমাকান্দা উপজেলার কালাইকান্দি গ্রামে। এভাবে শুরু হয় তাদের জীবনের নতুন সংগ্রাম। সংসারে তিন বেলা খাবার জোগার করার মত তাদের অবস্থা ছিল না, মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে যেটুকু আয় করতেন তাতে সংসার চালানো খুবই কষ্ট হতো। দারিদ্রতার চরম হি¯্রতার সাথে মুখোমুখি হয়ে শেষে বাধ্য হয়ে কাঁধে তুলে নেন সংসারের  বোঝা। কালাইকান্দি থেকে পায়ে হেটে ৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলমাকান্দায় কাজ শুরু করেন একজন মাছ ব্যবসায়ীর আড়তে। কিন্তু আড়তে কাজ তিনি বেশি দিন করতে পারেনি। নানানভাবে তাকে ঠকিয়ে চলছিল আড়তদার। বাধ্য তিনি মনযোগ দেন ব্যবসায়। শুরুতে তিনি নানা কাজে যুক্ত হয়েছেন যেমন: মাছের ব্যবসা, বরফ মিলে শেয়ার, মটরসাইকেল ভাড়া, মনোহারী দোকান, পুকুর লিজ নিয়ে মৎস খামার, লাকড়ী ব্যবসা ইত্যাদি কিন্তু সর্বশেষ ২০১২ সালে এসে ছোট পরিসরে খাবার দোকান দেন। দুই বছর পর এই খাবাবের দোকান আরো বড় আকারে দেন। দোকানের নাম দেন “মায়ের দোয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট”।

এই হোটেল এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই পর্যায় পর্যন্ত আসতে তাকে অনেক কষ্ট, বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে নানান বাজে মন্তব্য। অনেকের সাথে দ¦ন্দ্ব হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু কখনো পিছ পা হতে চাননি তিনি। প্রতিটি বাধা অতিক্রম করার তীব্র আকাংখা ছিল মনের মধ্যে। ব্যবসার টাকা একটু একটু করে জমা করে কলমাকান্দায় আড়াই শতাংশ জমি কিনেছেন ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা দিয়ে।

তিনি বলেন, “একজন নারী হয়ে আমার এমন একটার পর একটা ধাপ পাড় হয়ে উঠে আসার পিছনে মূলমত্র  হিসেবে কাজ করেছে কাজের প্রতি আমার প্রচন্ড আগ্রহ, সততা, ধৈর্য্য, অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়া। আমার কাছে ছোট হোক, বড় হোক সব কাজই সমান। যে কাজ ধরি তা শেষ করেই ছাড়ি।”

তার এই সরল বলার ভঙ্গিতে তিনি নানান বিষয়ে কথা বলেছেন। তার ভালোলাগা বা খারাপ লাগা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার ভালো লাগে যখন কারো কোন উপকার করতে পারি।” লাকী আরো বলেন, “ভালো লাগে সবার সাথে মিলে মিশে থাকতে। তবে একটা সময় ছিল তখন  আমিও তো ঠিক মত খেতে পারতাম না। তাই আমি জানতাম না খেয়ে থাকাটা কত কষ্টের।”

লেখাপড়ার ব্যপারেও তার ব্যাপক আগ্রহ। লাকী এবার উন্মুক্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দিবেন। সারাদিন দোকান সামাল দিয়ে গভীর রাতে পড়তে বসেন। দারিদ্রের সাথে অনেক লড়াই করেছেন এখন দারিদ্রের গন্ডি পেরিয়েছেন। তাই এখন হারিয়ে আসা স্কুল জীবনটাকে ফিরে পেতে চান। ফিরে পেতে চান শৈশবের অনেক স্মৃতি বিজরিত মুহূর্তকে। আরও পড়াশুনা করে সমাজটাকেও পাল্টাতে চান।
gun-1
তাঁর বক্তব্য, “নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক সময় অনেক কঠোর হতে হয়েছে।” তার মতে, “একজন পুরুষ যেখানে দোকান নিয়ে বসে আছে সেখানে একজন নারী কেন পারবে না। একজন নারী যদি তার সততা বজায় রেখে ব্যবসা করতে পারে তবে দোষের কি? সেতো আর কোন সমাজ পরিপন্থি কাজ করছে না।”

আর দশটা মানুষের জীবন আর লাকী আক্তারের জীবন এক না। তাঁর যে লড়াই, সংগ্রাম তা কেবল বইয়ের পাতায় দেখা যায়। এমন সংগ্রামী আর সাহসী নারীদের এ সমাজে আরো প্রয়োজন। তাইতো লাকী আক্তার স্বপ্ন দেখেন আর স্বপ্ন বুনে লেখাপড়া শেষে বড় একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করবেন, সরিষার মিল দিবেন যেখানে সরিষার প্রক্রিয়াজাতকরণ ও প্যাকেটজাতকরণ একসাথে হবে।

নির্যাতিত, সুবিধা বঞ্চিত ও অবহেলিত নারীদের উদ্দেশ্যে লাকীর বক্তব্য হলো, “জীবনে অনেক বাধা আসবেই তাই বলে থেমে থাকলে চলে না, কে কি বললো তা না দেখে সব কিছুকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে। পরিশ্রম, সততা, নিষ্ঠা ও কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে সফল হওয়া যায়।”

happy wheels 2