পানি আছে সুপেয় পানি নেই..
সাতক্ষীরা থেকে গাজী আল ইমরান
পানির অপর নাম জীবন। এ পানি ছাড়া প্রাণবৈচিত্র্যের অস্বিত্ব কল্পনা করা যায় না। তাই জীবনধারণের জন্য মানুষকে সর্বপ্রথম পানির কথা চিন্তা করতে হয়। বাস্তবে দেখা যায় শহরাঞ্চলে সুপেয় পানির ব্যবস্থা অনেকটা নিশ্চিত হলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপজেলা ও গ্রামগুলোতে পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে সেখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত পানি সঙ্কটে পড়েছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মানুষও নানাভাবে পানি সঙ্কটে রয়েছে। এই উপজেলার চারিদিকে পানি থাকলেও লবণাক্ততার কারণে সেই পানি পানযোগ্য নয়। তাই সুপেয় পানির আহরণের জন্য এলাকার মানুষ বিশেষ করে নারীরা দূর দূরান্তের পথ পাড়ি দিতে হয়। সকাল থেকে থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদেরকে এই কাজ করতে হয়। এমনও দেখা গেছে, উপজেলার কিছু কিছু গ্রামের নারীরা ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হয়। গাবুরা, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের অনেকেই ট্রলারযোগে এলাকার অন্য ইউনিয়ন থেকে পানি সংগ্রহ করেন। হিসেব করলে দেখা যায়, একজন মানুষ তার শ্রম দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যে এক কলস পানি নিয়ে আসে ঐ সময়ে তার শ্রমের মূল্য আসে প্রায় পঞ্চাশ টাকা অর্থাৎ এক কলস পানির দাম পঞ্চাশ টাকা।
শ্যামনগর উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৩১৩৭৮১ জন (সুত্র-উপজেলা প্রশাসন ওয়েব সাইট)। এই জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কোন না কোনভাবে সুপেয় পানির সঙ্কটে রয়েছে। দৈনিক সুপেয় পানি নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কেননা উপজেলার অধিকাংশ নদীনালা মৃত প্রায়। এছাড়া শুকিয়ে গেছে অধিকাংশ এলাকার বড় বড় খাল। অন্যদিকে এলাকার নলকুপের পানিতে লবণ ও আয়রনের উপস্থিতির কারণে নলকূপের পানিও আর নিরাপদ নয়। ফলশ্রুতিতে দিনকে দিন পানি সঙ্কট মহামারী আকার ধারণ করেছে উপেজলায়।
সুপেয় পানি অভাব মেটানোর জন্য উপজেলার অধিকাংশ মানুষ পুকুরের পানি পান করে। তবে জনসংখ্যা অনুপাতে মিঠা পানির পুকুরের সংখ্যাও খুব কম। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা আঘাত হানার পর সুপেয় পানির অভাব গাবুরা-পদ্মপুকুরে আরও প্রকট হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি অনেক সংগঠন পুকুর খনন ও পূনঃখননের কাজ করলেও সঠিক পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা এবং মনিটরিং-এর অভাবে কাজগুলো হয়েছে নিতান্ত দায়সারা গোছের। ফিল্টার কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, কত দিন পর পরিবর্তন করতে হবে, এটি ঠিকমতো কাজ করছে কি না, ফিল্টারে জমা হওয়া আর্সেনিক কোথায় ফেলতে হবে এসব পর্যবেক্ষণ করা বা নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। সুতরাং অনেক ফিল্টারই বিকল হয়ে আছে।
উপজেলার সদরের কাশিপুর গ্রামে বসবাসরত আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রাদয়ের মানুষদের কথা বলে জানা যায়, পানির জন্য হাহাকারের শেষ নেই তাদের। গ্রামের মেঠো পথ ধরে কয়েক কিলোমিটার হেটে যে পরিমাণ পানি আনা যায়, তার চাইতে শরীরে ঘাম যেন আরো বেশি বের হয় নারীদের। ভোরে সূর্য উকি দেওয়ার আগেই পানি আনতে যায় নারীরা কিন্তু পৌঁছুতে সামান্য দেরি হলেই সব মিলিয়ে তার দুই থেকে তিনটি মূল্যবান ঘণ্টা পেরিয়ে যায় পানি আনার কাজে। এ যেনো ছকে বাঁধা এক সংগ্রামী জীবন। সরেজমিনে শ্যামনগর উপজেলার ২১৬টি গ্রামের (সুত্র-উপজেলা প্রশাসন ওয়েব সাইট) অধিকাংশ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জনসংখ্যার অনুপাতে মিঠা পানির পুকুর নেই। চৈত্র মাস আসতে না আসতেই সুপেয় পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। এখানকার ৮০ শতাংশ মানুষের রোগ এবং মৃত্যুর প্রথম এবং প্রধান কারণ সুপেয় পানির অভাব। দূষিত পানি পান করে প্রতিবছর শত শত মানুষ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
পানি সঙ্কটকে প্রশমিত করার জন্য তাই উপজেলার যাবপুর গ্রামের শিক্ষার্থীরা দু’টি পুকুর নেট দিয়ে ঘিরে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছে। এ দু’টি পুকুর থেকে প্রতিনিয়ত প্রায় ২০০ পরিবার তাদের পানির সংকট মেটাতে সক্ষম হয়েছে। তাদের এই উদ্যোগ প্রসংশিত হয়েছে। এ এলাকার কিছু মানুষের দুঃখ লাঘবে এ তরুণরা ভূমিকা রাখতে পারায় তারা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। তরুণদের এই উদ্যোগকে আরও সম্প্রারণ করা দরকার বলে মনে করেন গ্রামবাসীরা। এছাড়া এলাকার যেসব মিঠা পুকুর আছে সেগুলো সংরক্ষণ, পুনঃখনন এবং সংস্কারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন এলাকাবাসী মনে করেন, জনসংখ্যানুপাতে প্রতি ওয়ার্ডে মিঠা পানির পুকুর খনন এবং প্রয়োজনমত বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা হলে উপজেলার মানুষ সুপেয় পানির সংকট থেকে রেহাই পেতে পারেন।