নেত্রকোণার চুলাসমূহ
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বাংলায় একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। এই রাঁধা বা রান্না করা আর চুল বাঁধা এই শব্দ দুটো কানে এলে একটা পরিচিত চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে চেহারা একজন নারীর। কারণ এই কাজ দু’টি করতে আমরা নারীকে দেখেই অভ্যস্ত। হ্যাঁ, একজন নারীর থাকে লম্বা চুল, তিনি সেই চুল পরিপাটি করে বেঁধে রাখেন। আর রইলো বাকি রান্নার কাজ। এই কাজটিও নারীদেরকেই করতে হয়। রান্নার জন্য প্রয়োজন হয় চাল, ডাল, সবজি, লাকড়ি, চুলা ইত্যাদি। চুলার নাম এলেই চোখে ভাসে গ্যাসের চুলা, কেরোসিন এর চুলা, অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক চুলা ও মাটির চুলা।
নেত্রকোণা জেলার গ্রামাঞ্চলে এখনো মাটির চুলায় রান্নার প্রচলন আছে। শুধুমাত্র শহরেই গ্যাস ও বিদ্যুতের সাহায্যে রান্না করা হয়। তাই গ্রামের নারীরা তাদের রান্না করার জন্য মাটির সাহায্যে বিভিন্ন নকশা ও নাম দিয়ে চুলা তৈরি করেন। ভিন্ন ভিন্ন জ্বালানি উপকরণের জন্যও আছে ভিন্ন নকশার চুলা। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে পুকুরের পানি শুকিয়ে যায়। তখন নারীরা চুলার জন্য পুকুরের গভীর থেকে মাটি সংগ্রহ করে। চুলা তৈরির জন্য আঠালো মাটি বেশি উপকারী। চুলা তৈরি করতে এই মাটির গোবর মিশিয়ে মাটিকে আরো শক্ত করা হয়। অনেক নারী বিভিন্ন আকার ও নকশার চুলা তৈরি করে ঘরে সংরক্ষণ করেন। নিজের প্রয়োজনে ব্যবহারের পাশাপাশি প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের মাঝেও চুলা বিতরণ করেন। নিচে নেত্রকোণা অঞ্চলের নারীদের তৈরি ও ব্যবহৃত কিছু চুলার নাম ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলোÑ
১। দ্বিমূখি ফাসি কাটা/আল কাটা চুলা
এই চুলা চারকোণাকৃতি, গোলাকার ও তিন কোণাকৃতির হয়ে থাকে। এই চুলার দুই দিকে মুখ কাটা থাকে। এই কারণে এই চুলার নাম আলকাটা বা ফাসি কাটা চুলা। এই চুলাতে লাকড়ি, পাতালতা ও খড়ের সাহায্যে রান্না করা যায়। একসাথে দুই ধরণের রান্না করা যায়। সময় কম লাগে। ধোঁয়া হয় না। পাতিলের নিচের অংশে সামান্য কালি জমা হয়। লাকড়ি কম লাগে।
২। শিকের চুলা
চুলার মাঝ বরাবর লম্বালম্বি বা আড়াআড়িভাবে লোহার শিক লাগিয়ে এই চুলা তৈরি করা হয়। এই চুলা সাধারণত গোলাকৃতি বা চারকোনাকার হয়। এই চুলাতে গোবরের ঘুটির সাহায্যে রান্না করা হয়। চুলাটি গ্যাসের চুলার মতো জ্বলে। ধোঁয়া হয় না। তাড়াতাড়ি রান্না করা যায়। গোবরের ঘুটি ও লাকড়ি উভয় উপকরণের সাহায্যে রান্না করা যায়।
৩। তিনকোণা চুলা
এই চুলা ত্রিকোণাকৃতির বলে এর নাম তিনকোনা চুলা। এতে লাকড়ি, খড়, পাতা ইত্যাদি দিয়ে রান্না করা হয়। এই চুলার উপরিভাগে তিন দিকে খাঁজ কাটা থাকে। এই চুলাতেও ধোঁয়া কম হয়, লাকড়ি কম লাগে। সময় কম লাগে।
৪। একমূখি ফাসি কাটা/আল কাটা চুলা
এই চুলা চুলাÑএই চুলা চারকোণাকৃতি, গোলাকার ও তিন কোণাকৃতির হয়ে থাকে। এই চুলার দুই দিকে মুখ কাটা থাকে। এই কারণে এই চুলার নাম আলকাটা বা ফাসি কাটা চুলা। এই চুলাতে লাকড়ি, পাতালতা ও খড়ের সাহায্যে রান্না করা যায়। সময় কম লাগে। ধোঁয়া হয়না। পাতিলের নিচের অংশে সামান্য কালি জমা হয়। লাকড়ি কম লাগে।
৫। সিঙ্গারা চুলা
এই চুলা সাধারণত গোলাকার। উপরিভাগে তিনদিকে একটু উঁচু রাখা হয়। বর্ষাকালে মাটির গভীরে চুলা পুঁতলে পানি উঠে ভিজে যায়। তাই এই চুলা মাটির উপরে রেখে লাকড়ি দিয়ে রান্না করা হয়। এই চুলাতে শুধু মাত্র লাকড়ির সাহায্যে রান্না করা যায়। চুলা থেকে আগুন বের হতে পারেনা বলে ধোঁয়া বেশি হয়। কালিও হয়। তবে রান্না করতে সময় কম লাগে। লাকড়ি কম লাগে।
৬। গায়না চুলা
এই চুলা আকারে বেশ বড় দেখতে হয়। এই চুলাতে শুধু লাকড়ি দিয়ে রান্না করা যায়। উপরের তিন দিকে পাতিল বসানোর জন্য সামান্য উঁচু থাকে। এই চুলা মাটির উপরিভাগে রেখে রান্না করা যায়। খুব বেশি গর্ত করার প্রয়োজন হয়না। তাড়াতাড়ি রান্না হয়। তবে ধোঁয়া হয় বেশি।
৭। ইটা চুলা
তিনকোনাকার ইটা চুলার উপরিভাগে তিনদিক উঁচু করা থাকে। ইটা চুলাতে লাকড়ি দিয়ে রান্না করা হয়। ভালো জ্বলে, তাই খুব তাড়াতাড়ি রান্না করা হয়। কালি ও ধোঁয়া হয়। লাকড়ি বেশি লাগে।
৮। তুষের চুলা/ভূষির চুলা
এই চুলা গোলাকার বা চারকোনাকার করে তৈরি করা হয়। এই চুলাতে ভূষি ও তুষ (ধানের খোসা) এর সাহায্যে রান্না করা হয়। তুষ বা ভুষি ভরে চুলার মুখে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই চুলাতে ধোঁয়া হয় না। রান্না করতে সময় কম লাগে। পাতিলের নিচের অংশে শুধু কালো হয়।
৯। জোড়া চুলা
এই চুলা তৈরি করা হয় দুটি ভিন্ন ধরণের চুলার সাহায্যে। ভিন্ন চুলাতে আগুন জ্বালানোর জন্য ভিন্ন দুইটি মুখ কাটা থাকে। দুইটি পাতিলে আলাদাভাবে রান্না করা যায়। দুইটি চুলাতে আলাদা ভাবে রান্না করতে হয় বলে সময় বেশি লাগে। ধোঁয়া বেশি হয়। লাকড়ি বেশি লাগে।
১০। তিনমুখি চুলা
এই চুলাতে সাধারণত তিনটি উপকরণ রান্না করা যায়। তিন কোনাকৃতির এই চুলাতে দুই দিকে মুখ কাটা থাকে। একদিক দিয়ে লাকড়ি দিতে হয়, অন্যদিক দিয়ে ছাই বের করে দেওয়া হয়। সাধারণত এই চুলার বেশি প্রচলন নেই। অনেকে শখের বশে তৈরি করেন। এই চুলাতে লাকড়ি বেশি লাগে। কম সময়ে রান্না করা যায়। সময়ও কম লাগে। ধোঁয়া হয়, তাই পাতিলে কালি জমে।