শহর ভূমিহীন মানুষের কৃষি: খাদ্য নিরাপত্তাসহ ঠান্ডা গরমেও সুরক্ষা দিচ্ছে
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
ভূমিকা
মাটি নেই, জমিও নেই, আবার পরের জায়গা। থাকার কোন নিশ্চয়তা নেই। আজ এখানে তো পরের মাসে হয়তো উচ্ছেদের কবলে পরে অন্য স্থানে বসবাস শুরু। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড রোদ খরা, গরম আবার জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত হয় নিজের ঝুপড়ি ঘরটি। হাটু পানি বা কোমর পানিতে ভাসতে হয় পরিবার নিয়ে। আবার শীতের সময়ে কনকনে শীতের কারণে থাকাই যেন দুষ্কর। এমনই পরিস্থিতির শিকার হন শহর প্রান্তিক মানুষগুলো। বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের মতো রাজশাহীতেও বস্তিবাসি প্রান্তিক মানুষগুলো এরকমই মানবেতর জীবনযাপন করে। কিন্তু এরপরও তাঁরা নানা দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে বেঁেচ থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে প্রমাণ করছে তাঁরাও উৎপাদন করেন, তাঁরাও দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। ভূমিহীন এই মানসুষগুলোর অনেকে এখন জমি ছাড়াই নিজের শাকসবজি নিজেরাই উৎপাদন করছেন। অনেকে নিজের পরিবারের চাহিদা মিটে অতিরিক্ত শাকসবজি বিক্রি করছেন বা পাড়া পরশীকে উপহার হিসেবে দিচ্ছেন, যা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
শহর থেকে গ্রামে একটি অভিজ্ঞতা বিনিময় ও ভূমিহীন সবজি চাষ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বস্তিশুমারি ২০১৪ সালের এক হিসেবে দেখা যায় রাজশাহীতে ছোট বড় মিলে বস্তির সংখ্যা ১০৪টি। মোট খানার সংখ্যা ১০২০২, যার জনসংখ্যা ৩৯০৭৭ জন। যার প্রায় ৮০.৫৫% খানা সরকারি জমিতে ঝুপড়ি বা ছোট টিনের ঘরে বসবাস করে। এই ভূমিহীন শহর প্রান্তিক মানুষগুলো মধ্যে কেউ কেউ খাস ও খালি জমিতে, মহাসড়ক বা রেললাইনের ধারে ছোট ছোট হালকা ঘর, ঝুপড়ি এক কক্ষ বিশিষ্ট টিনের ঘর বা প্লাসটিকে তৈরী ছাউনির মধ্যে বসবাস করছে। শীতের সময়ে কনকনে শীত আর গরমের সময়ে প্রচন্ড গরমে মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করে এই মানুষগুলো। এই মানুষগুলো একসময়ে নিজেদের গ্রামে কৃষির সাথে যুক্ত ছিলো। কিন্তু কাজ হারানো, বন্যা, খরা এবং জলবায়ু পরিবর্তনে নানা দুর্যোগের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে কাজের সন্ধানে, জীবিকার সন্ধানে শহরে বসবাস শুরু করে। এই মানুষগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নিজেরা বিভিন্নভাবে আয় ইনকাম করলেও বসবাসের জায়গায় বা ঝুপড়ি ঘরের পাশে কোন ধরনের শাকসবজি উৎপাদন করতে পারতোনা মূলত মাটির সমস্যার কারণে। এই সমস্যা সমাধানে উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ে সহায়তা করে। বারসিক নাচোলের কৃষি গবেষক রায়হান কবির রঞ্জু নিজে এই সমস্যা সমাধানে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছেন। তিনি ১২ ইঞ্চি ব্যাসার্ধেও একটি ক্যারেটে ভার্মী কম্পোস্ট এবং মাটি দিয়ে পরীক্ষামূলক শাকসবজি এবং আদার চাষ করে সফলতা পান। এই অভিজ্ঞতা শহরের ভূমিহীন মানুষের মধ্যে বারসিক বিনিময় করতে সহায়তা করে। শহরের মাটিতে নানা ধরনে বিষাক্ত উপকরণ থাকায় সেখানে সবজি চাষ সম্ভব হয়ে উঠেনা, আবার অন্যদিকে জায়গার স্বল্পতার কারণে কোন ধরনে চাষ করা সম্ভব হয়না। সেক্ষেত্রে ঝুপড়ি ঘরের পাশে একটি ক্যারেটে উন্নত মাটি, জৈব সার দিয়ে সেখানে সবজি চাষ করে নিজের পরিবারের সবজি চাহিদা মেটানো সম্ভব। একইসাথে কখনো এই মানুষগুলো স্থানান্তরিত হলে ক্যারেটটি খুব সহজেই অন্যত্রে স্থান্তর করা সম্ভব হয়। ভূমিহীন মানুষগুলো ক্যারেটে করে সবজি চাষে সফলতা পাচ্ছেন।
ক্যারেটে সবজি চাষে শুধু পারিবারিক চাহিদা মিটছেনা ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতেও ভূমিকা রাখছে
রাজশাহী শহরের নামোভদ্রা, বহরমপুর, শ্রীরামপুর এবং রুপালি বস্তিসহ বিভিন্ন বস্তিতে এখন ক্যারেট পদ্ধতিতে এবং গর্ত করে মাটি শোধন করে সবজি চাষ করছেন অনেকে। এই পদ্ধতিতে প্রায় ৫০ এর অধিক ভূমিহীন মানুষ শহরে তাঁদের ঘরের পাশে ক্যারেটে পুঁইশাক, শাক, লাউ, শীম, বেগুনসহ নানা জাতের সবজির চাষ করছেন। লতা জাতীয় সবজিগুলো টিনের চালে বা ঝুপড়ি ঘরের উপর তুলে দেয়া হচ্ছে। এর ফলে অতিরিক্ত রোদে এখন আর ঘরের চালা গরম হয়না, তাপমাত্রা সহনশীল থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে ঠান্ডার সময় চালার উপর সবুজ লতা জাতীয় শাকসবজির ডাল পালা থাকার কারেন ঠান্ডাও কম লাগছে। এ বিষয়ে নামোভদ্রা বস্তির গোলাপী বেগম বলেন, ‘আমাদের অনেক উপকার হচ্ছে, সবজি চাষ করে আমরা নিজে খেতে পাচ্ছি এবং এই সবজির গাছ চালাতে তুলে দেবার কারনে ঠান্ডা এবং গরম দুটো থেকেই কিছুটা হলেও রেহাই পাই।” তিনি আরো বলেন, ‘এর ফলে আমাদের শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। বাচ্চাদের রোগ বালাই কম হচ্ছে। আবার নিজেরা বিষমুক্ত শাকসবজি খেতে পাচ্ছি।’ বহরম পুর বস্তির শাহআলম একজন ট্রাক ড্রাইভার। তিনি রেল লাইনের ধারে বহরামপুর বস্তিতে বসবাস করছেন প্রায় ১০ বছরের অধিক সময় থেকে। বিগত ২ বছর আগে ক্যারেট পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে তিনি সফলতা পেলে পরে নিজ থেকেই আরো ৫টি ক্যারেট কিনে সেখানে বেগুন, মরিচ , শিম, লাইয়ের গাছ লাগান। লতা জাতীয় গাছ যেমন লাউ শীমের গাছগুলো টিনের চালাতে তুলে দেন। তিনি নিজের পরিবারের সবজির চাহিদা মিটায়ে বাকিগুলো সবজি বস্তির মানুষের মধ্যে বিলি করেন। শাহ আলম বলেন, ‘কাজের ফাকে বাড়িতে এসে এসব ক্যারেটের যতœ নিয়ে থাকি, ভালোই লাগে যে নিজে সবজি উৎপাদন করে খাচ্ছি, একই সাথে আরেকজনকেও সহায়তা করতে পাচ্ছি।” তিনি আরো বলেন, ‘করোনার সময় যখন লকডাউন, গ্রাম থেকে শহরে কোন ধরনের সবজি আসতো না, আবার সবজির অনেক দাম, সেই সময় তার এই উৎপাদিত সবজি অনেক উপকারে এসেছে।’
উপসংহার
দুর্যোগ দুর্ভোগে গ্রামে কাজ হারিয়ে মানুষগুলো শহরে নিরাপদ বসবাসের আশায় বসবাস করতে আসলেও শহরেও তাঁদের দূরদশা যেন থেমে নেই। বর্ষাকালে জলবদ্ধতা, গরমে প্রচন্ড গরম, শীতকালে করকনে শীত নিয়ে কাটতে হয় তাদের শহরে। অন্যদিকে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তনসহ নানা কারণে তাদের শরীর স্বাস্থ্য এমন কি ঘরের জিনিষপত্রও নষ্ট হয়। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য ক্যারেট পদ্ধতিতে সবজি চাষ আশার আলো দেখাচ্ছে ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে। একদিকে নিজেরা নিরাপদ সবজি উৎপাদন করে খেতে পাচ্ছে, অন্যদিকে রোগ, গরম বা ঠান্ঠায় এই সবজি গাছ তাঁদের সুরক্ষা দিচ্ছে। আবার খুব সহজেই স্থানান্তরিত হলে ক্যারেটগুলো তুলে তা অন্যত্র সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে। শহর ভূমিহীন বস্তিবাসীর ক্যারেট পদ্ধতিতে সবজি যেমন খাদ্য নিরাপত্তায় অবদান রাখছে তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নযনেও কিছুটা হলেও অবদান রাখছে। এই অভিজ্ঞতা এবং দৃষ্টান্ত আরো বেশি বিনিময় হলে শহরও খাদ্য উৎপাদনে অবদান রাখবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিদের্শনায় প্রতি ইঞ্চি মাটির ব্যবহার করে খাদ্য নিরাপত্তায় বিশেষ অবদান রাখবে।