সাম্প্রতিক পোস্ট

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করছে রবিদাস সম্প্রদায়

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের একটি গ্রাম বাইশদার। এই গ্রামে একসময় জেলে, কামার, মাঝি, কৃষক, মুচি, নাপিত সকল পেশার জনগোষ্ঠীর লোকজন বসবাস করতেন। কিন্তু বর্তমানে জেলে, মুচি আর মাঝিদের পেশার বিলুপ্তি ঘটেছে। কৃষক, কামার আর নাপিত সম্প্রদায়ের লোকজন আছেন। এর মধ্যে আবার কৃষক ও কামার সম্প্রদায় তাঁদের নিজ নিজ পেশা কোনো রকমে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে রবিদাস সম্প্রদায়ের যারা আগে জুতা সেলাই ও চামড়ার ব্যবসা করতেন এখন আর তাঁদের সেই পেশা নেই। যারা আগে এই ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিল তাঁদেরও বয়স হয়েছে। পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না। তাছাড়া আগের মতো চামড়াও পাওয়া যায়না। বিভিন্ন কোম্পানির লোকেরা কিনে নেয়। নিজস্ব জমি নেই বলে চাষবাস করার সুযোগ নেই। যাদের পরিবারে উপযুক্ত ছেলে আছে তাঁদের ছেলেরা এলাকার বিভিন্ন বাজারে নাপিতের কাজ করেন।

বর্তমানে বাইশদার গ্রামে রবিদাস সম্প্রদায়ের ৭টি পরিবার বসবাস করে। আগে ৮টি পরিবার ছিল। কিন্তু এখানে উপার্জনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় একটি পরিবার অনেক আগেই গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। বাকি পরিবারগুলো কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছে। ৭টি পরিবারে মোট ৪৭জন সদস্য আছে।

ঠিক কবে থেকে রবিদাস সম্প্রদায়ের লোকজন এই গ্রামে আছে সেটি সঠিক করে বলতে পারেনা। সবচে’ প্রবীণ নারী ফুলবাসী রানী (৭৫) অনেক ছোট বয়সে বৌ হয়ে এসেছিলেন এই গ্রামে। তাঁর স্বামীর পরিবার এখানে থাকতো। তখন আশে পাশে কোনো বসতি ছিল না। চারদিকে জঙ্গল। আর অনেক জায়গাই ফাঁকা ছিল। তিনি যখন এই গ্রামে আসেন তখন দেখেছেন নদীতে জাহাজ চলে। গ্রামের পাশ দিয়ে যে নদী বয়ে গেছে সেটির নাম সাইডুলি। তিনি উঠানে দাঁড়িয়ে জাহাজ চলাচল দেখতেন। পরে আস্তে আস্তে আরো পরিবার এখানে এলো। তাঁরও দুই ছেলে জন্মালো। এভাবেই এখানে রবিদাস সম্প্রদায়ের বসতি গড়ে উঠে। তাঁদের বসতি ‘মুচার পাড়া’ নামে পরিচিত। এই পাড়া আয়তনে বেশি বড় নয়। খুব বেশি হলে ২০ শতাংশ জায়গা হবে। এখানেই ঘিঞ্জি পরিবেশে ৭টি পরিবার থাকে। প্রত্যেক পরিবারের থাকার জন্য একটি করে ঘর আছে। রান্না ঘর বলে আলাদা কিছু নেই। কেউ বারান্দার একপাশে, কেউ বসত ঘরের কোণে কেউ আবার উঠোনে চুলা বসিয়ে রান্না করেন।

IMG_20191218_121236_624

তবে সবচেয়ে সুবিধার জায়গা হলো সাইডুলি। এর জল দিয়ে তাঁরা সকল কাজ সারতে পারেন। স্নান করা, কাপড় কাঁচা, বাসন-কোসন ধোয়াসহ নিত্য দিনে বিভিন্ন কাজ। শুষ্ক মৌসুমে নদীর জল যখন শুকিয়ে যায় তখন একটু কষ্ট হয় বটে। তবে নদীর মাঝখানে গর্ত করে জল সংরক্ষণ করেন তাঁরা। সেই জলেই প্রয়োজন মেটান। খাবার জলের সমস্যাও তাঁদের নেই। এই পাড়ায় দুইটি টিউবওয়েল আছে। সেটি ব্যবহার করে রান্না ও খাওয়ার কাজ চলে। সবচে’ সমস্যার জায়গা হচ্ছে ল্যাট্রিন ব্যবহারে। কারণ এই ৭টি পরিবারের মধ্যে মাত্র একটি ল্যাট্রিন আছে। তাও আবার একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া। প্রতিদিন এই ল্যাট্রিন ব্যবহার করার জন্য প্রত্যেক পরিবারের সদস্যদের লাইন ধরতে হয়। ছোট সদস্যরা তো সুযোগই পায় না। তারা নদীর পাড়ে বা জঙ্গলের ধারে পায়খানা করে। বেশি সমস্যায় পড়ে নারী ও কিশোরীরা। পুরুষদেরও তেমন সমস্যা হয়না। তারা অনেক সময় অন্যের জঙ্গলে গিয়ে পায়খানা করেন। একদিকে ঘন বসতি অন্যদিকে খোলা জায়গায় মল ত্যাগের কারণে পাড়ার পরিবেশ দিন দিন অস্বাস্থ্যকর হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এতগুলো মানুষ একটি ল্যাট্রিন ব্যবহার করার কারণে সেটিও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

এই পরিবারগুলোর সদস্যদের রোজগার কম। কিন্তু অল্প রোজগারে সকল চাহিদাই পূরণ করতে হয়। সেলুনে কাজ করে যা রোজগার হয় তা দিয়ে পরিবারের সকলের খাবার যোগাড় করাসহ অন্যান্য চাহিদা ঠিকমতো পূরণ হয়না। তাই যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা থাকা স্বত্বেও কোনো পরিবার নিজেদের জন্য আলাদাভাবে কোনো ল্যাট্রিন স্থাপন করতে পারছেন না। বা কোনো সংস্থা, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাঁদের এই সমস্যা সমাধানে কখনো এগিয়ে আসেনি। বছরখানেক আগে কোনো একটি অফিসের (নাম বলতে পারেনা) একজন তাঁদের নাম ঠিকানা লিখে নেয়ার পাশাপাশি পরিবার প্রতি ২০০ টাকা করে নিয়ে গেছে। বিনিময়ে তাঁদেরকে ল্যাট্রিন তৈরি করে দেবে। কিন্তু এর পরে সেই অফিসের আর কোনো খোঁজ নেই। মোবাইলে যোগাযোগ করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে কেউ তাঁদের ঠকিয়েছে। যে কারণে তাঁদের বিশ্বাসের জায়গাটা কমে গেছে।

বাইশদার গ্রামে গ্রাম সভা, গ্রাম প্রোফাইলের তথ্য সংগ্রহ, দৈনিক তথ্য ফরমেট পূরণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক আলোচনা, পেশাভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করার মাধ্যমে উক্ত সম্প্রদায়ের ল্যাট্রিন এর সমস্যাটি উঠে আসে। রবিদাস সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য গ্রামের অন্যান্যদের সাথে সহভাগিতা করা হয়। তাঁদের কাছ থেকেও তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়। রবিদাস সম্প্রদায়ের ল্যাট্রিনের সমস্যাটি উপজেলা চেয়ারম্যান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সামনে তুলে ধরা হয়। এই কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন উক্ত ইউনিয়নের সচিব মহোদয়।

সকলের উপস্থিতিতে অত্র ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রবিদাস সম্প্রদায়ের ৬টি পরিবারের মধ্যে ৩টি পরিবারের জন্য ল্যাট্রিন তৈরির উপকরণ প্রদান করতে সম্মত হন। বাকি ৩টি পরিবারের জন্য তিনি বারসিক’র সহযোগিতা কামনা করেন।

বারসিক’র সহযোগিতায় তিনটি পরিবারের প্রত্যেকটিতে ৪টি করে রিং ও একটি করে স্লাব কিনে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান ও বারসিক’র সহায়তায় বাইশদার গ্রামের রবিদাস সম্প্রদায়ের ৬টি পরিবারের ল্যাট্রিন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে। ফলে তাঁদের এলাকার পরিবেশে সুস্থতা বিরাজ করবে।

happy wheels 2

Comments