সহায়তা পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি পেশা ছাড়তে চান নাজমুন নাহার
সাতক্ষীরার, শ্যামনগর থেকে বিশ^জিৎ মন্ডল ও আল ইমরান
প্রাচীনকাল থেকেই মানব সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি চলে আসছে। আর এটি বিভিন্ন ধরনরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-ব্যাধি, অশিক্ষা, প্রতিবন্ধীতা, দারিদ্রতা, শোষণ, বঞ্চনা, সম্পদ অন্যের ভোগ দখল, কর্মবিমুখতা ইত্যাদির কারণে সম্প্রসারণ ঘটছে। ভিক্ষাবৃত্তি যেন একটি সামাজিক ব্যাধি। এটি কোন স্বীকৃত পেশা নয়। কেউ ইচ্ছে করে ভিক্ষুক হচ্ছে না। তার পিছনে আছে নানান কারণ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটছে। আর এখান থেকে দেশের দারিদ্র নিরসণের লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মধ্যে ভিক্ষাবৃত্তির পেশা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর আবাসন ও ভরণ-পোষণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ভিক্ষুকদের পুনবার্সনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে।
সারা বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলায় সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অধীনে সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সে কাজের ধারাবাহিকতায় শ্যামনগর উপজেলায় সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভিক্ষুক চিহ্নিতকরণ এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তা করছে। সে লক্ষ্যে উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ভিক্ষুক চিহ্নিতকরণ কার্যক্রমে বারসিক থেকে সহায়তা করা হয়। বারিসক থেকে উপজেলার ইশ^রীপুর, কাশিমাড়ি, আটুলিয়া, মুন্সিগঞ্জ ও শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ১৭ জন ভিক্ষুক পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তার মধ্যে থেকে খুবই প্রান্তিক এবং বিগত সময়ে কোন সহযোগিতা পায়নি তেমন একটি পরিবার চিহ্নিত করা হয় এবং নাম প্রস্তাব করা হয। উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের কাঠাল বাড়ি গ্রামের বিশেষভাবে সক্ষম ও ভিক্ষুক নাজমুননাহারকে। সে প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে নাজমুননাহারকে কি ধরনের সহায়তা করা যেতে পারে বা তিনি কি ধরনের সহায়তা পেলে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দেবেন এবং সংসারে আয়ে ভূমিকা রাখবেন সে চাহিদা গ্রহণ করা হয়। এবং তার চাহিদা অনুযায়ী উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে গত ২৪ আগস্ট তাকে নগদ ২০ হাজার টাকা প্রদান করা হয় এবং বারসিক থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় সহায়তা করা হয়। তার চাহিদা অনুযায়ী হাঁস-মুরগি, পুকুরে মাছ চাষ, পুকুর সংরক্ষণের উপকরণ, হাঁস-মুরগির ঘর তৈরি, সবজি চাষের পরিবেশ, হাঁস-মুরগির খাবার, তার পরিবারের খাবার ও একটি মোবাইল ফোন ক্রয় করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে কাঠালবাড়ি গ্রামের নারী সংগঠনের সভানেত্রী বলেন, ‘আমরা গ্রামের সবাই মিলে নাজমুন নাহারের পরিবারকে বিগত সময় থেকে বিভিন্ন সহায়তা করে থাকি। তাকে আমাদের নারী সংগঠনের একজন সদস্য করেছি। মাসে মাসে তিনি ৫০ টাকা করে সঞ্চয় জমা দেবেন। আর বারসিক যোগাযোগ করে তাকে যে সহায়তা করে দিয়েছে এটি খুবই ভালো একটি কাজ। অসহায় পরিবারটির আয়ের পথ তৈরি হবে। তাকে হয়তো বা আগের মতো আর কারো কাছে হাত পাততে হবেনা।’
সহায়তাপ্রাপ্ত নাজমুন নাহার বলেন, ‘আমার কপাল খুব খারাপ। আমরা খাস জায়গায় বাপের ভিটায় বসবাস করি। আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী তেমন কোন ভারী কাজ করতে পারি না। তারপরও বাবা আমাকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করিয়েছিলেন। আমাকে যাতে ভিক্ষা করে খেতে না হয সেজন্য বাবা মা ও গ্রামের লোকেরা আমাকে একজন বয়স্ক মানুষের সাথে বিয়ে দেয়। সে গ্রামে গ্রামে ফেরি করতো যশোর থেকে এসে আমাদের গ্রামে থাকতো। বিয়ের কয়েক বছর যেতে না যেতে আমাকে ও আমার সন্তানদের রেখে চলে যায়। আর কোনদিন ফিরে আসেনি। আমার সংসারে এখন ৪ জন সদস্য আমার দুই সন্তান ও আমার খালা। আমার খালাও প্রতিবন্ধী কিছু করতে পারেনা। পরিবারে খালা আর আমি দুজনেই ভিক্ষা করি। এখন যে সহায়তা পেয়েছি তা যদি ভালোভাবে চালাতে পারি তাহলে হয়তো আর আমাদের ভিক্ষা করা লাগবেনা। ছেলে দুটিকে মানুষ করতে পারবো।’
নাজমুন নাহারের মতো অসংখ্য পরিবারে এরকম নানান সমস্যা আছে। আর এ সমস্যা থেকে বের হতে না পেরে ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশাকে বেছে নিয়েছে। এসকল পরিবারকে যদি সরকারি-বেসরকারীভাবে বিভিন্ন উপকরণ, প্রশিক্ষণ ও আর্থিকভাবে সহায়তা করে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া যেতো তাহলেই হয়তো বা তা ভিক্ষা বৃত্তি নামক সামাজিক ব্যাধি থেকে বের হতে পারতো।