কৃষকের সংগঠন কৃষকের শক্তি
নেত্রকোনা থেকে পার্বতী রানী সিংহ
কৃষি প্রধান অঞ্চল ও বাংলা সংস্কৃতির ধারক হিসাবে নেত্রকোনা জেলা পরিচিত। এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কৃষি পেশার সাথে যুক্ত। নেত্রকোনা জেলার চল্লিশা ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক-কৃষাণীরা এর ব্যতিক্রম নয়। বেশিরভাগ কৃষক দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে জীবন নির্বাহ করে। নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে জমি বিক্রি, মহাজনী সুদ/ঋণ করে নিজস্ব জমি হারিয়ে নিজেদের পরিচয় হারিয়ে কৃষি শ্রমিকের পরিচয় লাভ করছিল। গ্রামে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। সেই সময়ে নিজেদের এবং সমাজে কৃষকের অবস্থার পরিবর্তনের কথা ভাবেন গুটি কয়েকজন কৃষক। নিজেদের ভাবনা/চিন্তা সহভাগিতা করেন আরো কয়েকজন কৃষকদের সাথে। সকলের সাথে আলোচনা করার পর নিজেদের একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা।
যেভাবে সংগঠন গড়ে ওঠেছে
২০১৪ সালে ৩০ জন কৃষক একত্রিত হয়ে বারসিক’র সাথে যোগাযোগ করেন। যোগাযোগের প্রেক্ষিতে বারসিক কর্মকর্তা মো: আলমগীর এর সাথে আলোচনা সভা করেন। সভার পর ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি নিয়ে ৩০ জন সদস্য নিয়ে সমাধান নামে যাত্রা শুরু করে। ৩০ জন কৃষক কৃষক সংগঠন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে আর ২০ টাকা করে সঞ্চয় করা শুরু করে। ৫ থেকে ৬ মাস পর জমানোর পর নিজেদের সঞ্চয় পরিমাণ কম হওয়ার কারণে ৫০ টাকা করে জমানো শুরু করেন এবং প্রতি মাসের ২ তারিখ সভা করা শুরু করেন। এভাবে ২ বছর সঞ্চয় করার পর আবারো সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ান সদস্যরা। ১০০ টাকা করে সঞ্চয় শুরু করেন এবং মৌসুমভিত্তিতে ৫০০/১০০০ টাকা সঞ্চয় করেন। তবে পরর্বতীতে সংগঠনটি ধান শালিক কৃষক সংগঠন নামে পরিচিতি লাভ করে। সঞ্চয়ের টাকার নিরাপত্তার জন্য তারা ব্যাংক একাউন্ট করেন।
সংগঠনের অগ্রযাত্রা
সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে জমি লিজ নিয়ে চাষ করা শুরু করেন সদস্যরা। তাছাড়া প্রাণী সম্পদ পালনের জন্য, সবজি চাষ, ধান চাষের জন্য নিজেদের সঞ্চয়ের টাকা থেকে নিজেরা ৫% হারে ঋণ নেওয়া শুরু করেন। মাসিক কিস্ততে সেই টাকা পরিশোধ করেন তারা। সংগঠনের সকল হিসাব নিকাশের দায়িত্ব পালন করে সংগঠনের কমিটি সদস্যবৃন্দ। যখন কোন সদস্য পারিবারিক সমস্যা,অসুস্থতা,পড়াশুনার খরচ, বিয়ে, কেউ যদি প্রাণী সম্পদ ক্রয় করে কোন রকম লাভ ছাড়া টাকা লেনদেন করেন অর্থ্যাৎ কিছু অর্থ হাতে রাখেন আপদকালীন সময়ে ব্যবহার করার জন্য। আর এই সুবিধা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। কৃষিজমি লিজ নিয়ে সংগঠনে যাদের জমি নেই তাদের দিয়ে বৈচিত্র্যময় সবজি, ধান চাষ, প্রাণী সম্পদ পালন, বৃক্ষরোপণ,দরিদ্র ব্যক্তিদের সহায়তা কার্যক্রম শুরু করেন। সঞ্চয় বাড়তে থাকল এবং প্রত্যেক সদস্যর নামে কৃষি ব্যাংকে ৭ বছরের জন্য লাখপতি স্কীম করেন তাঁরা। স্কীমের ৩ বছর পূর্ণ হলো। ৭ বছর পর ৩০ জন কৃষক প্রত্যেকে ১ লাখ টাকা পাবেন নিজেদের সঞ্চয়, লভ্যাংশ ছাড়া। যেখানে অন্য কৃষকেরা নিজেদের পরিবার চালাতে কষ্ট হয় সেখানে এই সঞ্চয় কৃষকের মনের সাহস জোগায়। মহাজনী ঋণের জন্য অন্তত এই ৩০ জন কৃষককে যেতে হয়না। নিজেদের পরিচয় বিক্রি করতে হবে না। নিজেদের চাষের জন্য সঞ্চয়ের টাকা থেকে ট্রাক্টর কিনে সংগঠনের সম্পদ সংরক্ষণ করেন। মৌসুম ভিত্তিতে সংগঠনের একজনকে দায়িত্ব দিয়ে জমি চাষের কার্যক্রম চলমান রাখেন। নিজেদের সদস্যদের ক্ষেত্রে ১৫০ টাকা কাঠা প্রতি আর সংগঠনের বাইরে ২০০ টাকা করে চাষ করেন। দায়িত্বে থাকা ব্যাক্তিকে সম্মানী প্রদান করেন তারা। আর এর পুরো কাজটা সংগঠনের মিটিংএর সিদ্ধান্ত অনুসারে বাস্তবায়ন করা হয়।
তাছাড়া সংগঠনে বেশির ভাগ কৃষকের কোন নিজস্ব জমি নেই। কেউ জমি বর্গা নিয়ে, কোন সদস্য গরু পালন করে, হাসঁ পালন করে, সবজি চাষ করে তারা কিভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে সেই পরিকল্পনা ও পরার্মশ দেওয়া হয় সংগঠনে। সকলের পরার্মশ নিয়ে সকল সদস্য কাজ করেন। বর্তমানে সংগঠনে প্রায় ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয় রয়েছে এই সংগঠনের। এরপর রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির জন্য নেত্রকোনা সমবায় অধিদপ্তর থেকে সংগঠন রেজিষ্ট্রেশন করা হয়। রেজিষ্ট্রেশনে বারসিক তাদের সহযোগিতা করে।
সমাজে সংগঠনের অবদান/নেতৃত্ব তৈরি
যখন নিজেদের সঞ্চয় বাড়তে থাকল তখন সদস্যরা এলাকায় সহযোগিতা শুরু করেন। আস্তে আস্তে যাত্রার পথ অগ্রসর হতে শুরু করে। নিজেদের সঞ্চয় বাড়ানো বা সুবিধাগুলো শুধুমাত্র নিজের সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রামে ছড়িয়ে দেন তারা। হাত বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার। সংগঠনের বাইরে হাসঁ-মুরগি পালন, ছাগল পালন, গরু পালনে আগ্রহী, রিক্সা পোলট্রি, হেনট্রলী, কাঠের ব্যবসা,মাছ চাষে, কৃষি কাজে উদ্যোগীদের সহায়তা শুরু করেন তারা। নিজের এলাকার প্রায় ২০০ জন কৃষক কৃষাণী এর সুবিধা পেয়েছে। কেউ হঠ্যাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসা পেতে হাত বাড়িয়ে দেয় সংগঠনের সদস্যরা। সেটা আর্থিকভাবেও আবার নিজেরা উপস্থিত থেকেও সহায়তা করে। সংগঠনের সদস্যরা এলাকার সকল সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করেন। সমাজের বিশৃঙ্খলা রোধে অনেক তৎপর। তাছাড়া সামাজিক সকল কাজ বাস্তবায়নে তরুণ সমাজকে সঙ্গে রেখে বাস্তবায়ন করেন সংগঠনের সদস্যরা। এভাবে আস্তে আস্তে সমাজে তাদের নিজেদের অবস্থান দৃঢ় হতে শুরু করে। সংগঠনের সদস্যরা এলাকার সামাজিক কাজ যেমন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গোরস্থান সংস্কার, মসজিদ নির্মাণে, ঈদগাহ মাঠ সংস্কার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, সমাজের সমস্যা সমাধানে সহায়তা, প্রান্তিক কৃষকের মেয়ে বিয়েতে সহায়তাসহ করোনাকালীন সময়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য সহায়তা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা, শিশুদের পড়াশুনার উপকরণ সহায়তা, সামাজিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সামাজিকভাবে কিংবা পারিবারিকভাবে কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের আলোচনা শুরু হয় সংগঠনের ঘর থেকে। আলোচনায় আপ্যায়নের/বৈঠকের সমস্ত খরচ বহন করে সংগঠন। এলাকায় বিয়েসহ সামাজিক যে কোন অনুষ্ঠান হলে সংগঠন তাদের খরচ কমিয়ে আনার জন্য নিজেদের সংগঠনে সংরক্ষণ করেছেন অনুষ্ঠানে রান্নার আসবাপত্র, চেয়ার, টেবিল দিয়ে সহায়তাসহ নিজেরা দায়িত্ব নেন অতিথি আপ্যায়নের। এতে করে পরিবারগুলোর ডেকোরেশন খরচ, বার্বুচি খরচ ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা কমে যায় এবং সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান শেষ করতে পারেন। এখন পর্যন্ত ১০০ জনের অধিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভাতা পেতে সহায়তা করেছেন সংগঠনের সদস্যরা। প্রায় ২০০ জন এখান থেকে ঋণ সুবিধা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন রিক্সা, অটো রিক্সা ২ জন, গরু কিনেছেন ৪ জন, হাসঁ-মুরগির র্ফাম করেছেন ২ জন এবং শুধুমাত্র হাঁস পালনে সহায়তা পেয়েছেন ১৫ জন। বাকিরা মৌসুমভিত্তিক চাষের জন্য সহায়তা পেয়েছেন।
সরকারি সেবা পরিসেবায় সংগঠন
সংগঠনের সদস্যরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সহায়তা পেয়ে থাকেন এবং নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। ২০২২ সালে গভীর নলকূপ পেয়েছেন সংগঠনের সদস্যরা এবং এলাকায় পেতে সহায়তা করেছেন ৬ জনকে।
সংগঠনের জৈবকৃষি র্চচা
যেহেতু অন্যান্য এলাকার চেয়ে রামকৃষ্ণপুর গ্রামে প্রাণী সম্পদ পালন করা হয় একটু বেশি সেজন্য গোবর সারের ব্যবহারের র্চচা এখনও ধরে রেখেছেন। গর্ত কম্পোস্ট, ছাই জমিতে বেশি ব্যবহার করেন। সংগঠনের সদস্যরা বাড়ির চারপাশ ব্যবহার করে সবজি চাষ করেন এবং নিজেদের পরিবারের ব্যয় স্বাশ্রয় অর্থনীতিতে অবদান রাখেন এবং নিরাপদ খাদ্যের যোগান দেন।
সংগঠনের বীজ বিনিময়
সংগঠনের সদস্যরা নিজেরা ধানসহ সবজি বীজ সংরক্ষণ করেন। প্রতিবছর সবজি, ধান, মসলা জাতীয় বীজ সংরক্ষণ করেন এবং নিজেদের মধ্যে বিনিময় করেন। সবজি চাষের জন্য কারো কাছে বীজ থেকে চারা করার উপযুক্ত জমি না থাকলে ১ অথবা ২ জন বীজ থেকে চারা করেন এবং আগ্রহী কৃষকদের মধ্যে বিনিময় করেন। কোন সদস্যর কাছে কোন মসলা বা সবজি চারা বেশি থাকলে তা নিজেদের মধ্যে বিনিময় করেন। কোন কৃষকের ফসল সম্পর্কে যে কোন তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্র গড়ে ওঠেছে সংগঠনের ঘর/কৃষি তথ্য কেন্দ্র।
সংগঠনের অর্জন
ধান শালিক সংগঠনটি দেশের গ্রামীণ জনপদে কৃষকের নিজস্ব স্বাধীন সংগঠন হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে এবং কৃষক কৃষক জ্ঞান অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে স্বাধীন সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। তাছাড়া কৃষিজমি রক্ষা, কৃষক-কৃষক অভিজ্ঞতা ও কৃষি সহযোগিতা, স্থানীয় নেতৃত্ব গঠনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সুযোগ বাড়ানো ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের এই অবদানকে স¦ীকৃতি দিতে ২০২১ সালে শ্রেষ্ঠ সমবায় সমিতি পুরষ্কার এবং ২০২২ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সমবায় সমিতি পুরষ্কার লাভ করে এই সংগঠনটি।
সংগঠনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা
ধানশালিক সংগঠনটি গ্রামীণ সমাজের স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে এবং দেশের বৈচিত্র্যময় কৃষি এবং বীজে কৃষক-কৃষাণীর স্বনির্ভর অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য। সংগঠন নিজ এলাকার প্রাণবৈচিত্র্যে অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এলাকার সমমনা সংগঠনগুলোর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। সংগঠনের সদস্যরা নিজ সংগঠন ছাড়াও আশেপাশের অধিকারবঞ্চিত জনগণকে সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ তথা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।