সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলি
:: বারসিক শ্যামনগর সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান
দুর্যোগপূর্ণ পদ্মপুকুর
বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের জরিপে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সর্বাধিক দুর্যোগ ও ঝূঁকিপূর্ণ জনপদ হচ্ছে শ্যামনগর উপজেলা। এর মধ্যে উপজেলার পদ্মপুকুরে অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। ইউনিয়নের চারিধার খোলপেটুয়া নদী; মোট ৩৪ কিলোমিটার নদীর চর। এ ইউনিয়নে মোট ৯টি ওয়ার্ডের ১৫টি গ্রামে ২৭৪৮১ জন মানুষের বসবাস। ইউনিয়নে ৮টি সাইক্লোন শেল্টার (২টি নির্মাণাধীন) ও ২টি মাটির কেল্লা রয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের মতে, জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে এ এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন। এই দুর্যোগ মোকাবিলার সবচে বড় অস্ত্র হতে পারে বনায়ন করা। উপকূলজুড়ে সবুজ বনায়ন গড়ে তোলা হলে সামদ্রিক ঝড়-জলেচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির হাত থেকে উপকূলীয় এলাকার মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের সুরক্ষা করা যেমন করা যাবে তেমনিভাবে নিঃসৃত কার্বন হ্রাসেও ভূমিকা রাখবে এ সবুজ বেষ্টনী। এই পরিপ্রেক্ষিতেই স্থানীয় জনগোষ্ঠী পদ্মপুকুরজুড়ে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন।
দুর্যোগ মোকাবিলায় সবুজ বেষ্টনী তৈরি
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সবুজ বেষ্টনী তৈরির প্রক্রিয়া হিসেবে তারা পরীক্ষামূলকভাবে খোলপেটুয়া নদীর ২ কিলোমিটার চর ও বাঁধে বনায়ন শুরু করে দেন। তারা নদীর চরে সুন্দরবনের কেওড়া, গোল, বাইন, কাঁকড়া, পশুর, খলিসার বীজ ও চারা এবং নিম, শিশু, বাবলা, তেঁতুল, খৈ ও পরশপেপুল গাছ রোপণ করে। তাদের এই উদ্যোগকে বেগবান করার জন্য বারসিক সহযোগিতা করে। গাছের পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণে তারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করছে। একই সাথে বনায়নে সংশ্লিষ্ট উপজেলা সামাজিক বন বিভাগ ও ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিে জনগোষ্ঠীর এই সবুজ বন তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হয়। এভাবে সামাজিক বনায়ন অধিদপ্তর থেকে আট প্রকার গাছের চারা দেওয়া হয়েছিল। সেই চারাগুলো নিয়ে স্থানীয় জনগণ ওয়াপদা ভেড়ি বাঁধের রাস্তার দুই ধারে রোপণ করেন।
সুবজ বেষ্টনী তৈরির প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়ান বৃক্ষপ্রেমিক জাকির হোসেন
পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের যুবক জাকির হোসেন আইলা পরবর্তী সময়ে নিজ উদ্যোগে নিজের বাড়ির সামনে নদীর চরে সুন্দরবনের কেওড়া, কাঁকড়া, গরান, বাইন, খলিশা, পশুর, গোল ফলের বন তৈরি করেছেন। তাঁর তৈরি করা বনে গাছগুলো বড় হয়ে সবুজ বন বেষ্টনী তৈরি করেছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে তিনি তার নার্সারি থেকে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করেছেন পুরো ইউনিয়নে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করার জন্য। তিনি প্রতিবছর কেওড়া গাছের নার্সারি করে হাজার হাজার গাছের চারা মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করছেন। এই প্রসঙ্গে জাকির হোসেন বলেন, “২০১৩ সালে বারসিক’র সহযোগিতায় কয়রায় নদীর চর বনায়নের কাজ দেখতে যায়। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি লবণসহনশীল সুন্দরী, গরান, বাইন, কাঁকড়া, খলিশা, পশুর, গোল ও কেওড়ার ফল সংগ্রহ করি এবং ফলগুলো সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে নার্সারি তৈরি করি। আমার কেওড়ার নার্সারি থেকে বিনামূল্য অনেক মানুষের মাঝে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করেছি”। জাকির হোসনের মতো বৃক্ষপ্রেমিক মানুষের সৌজন্যে বর্তমানে পদ্মপুকুর ইউনিয়নে অনেকগুলো স্থানীয় লবণসহনশীল গাছের বনায়ন করা সম্ভব হয়েছে।
বনায়ন মজবুতে ঘাস রোপণ
সামাজিক বনায়ন অধিদপ্তর থেকে যে আট প্রকার গাছের চারা দেওয়া হয় সেগুলো আমরা রোপণ করলেও অতিবৃষ্টির কারণে রাস্তা ভেঙে গাছের গোড়া থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো। তাই স্থানীয় জনগণ রাস্তার দু’ধারে ঘাস লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। ঘাস লাগালে যেমন মাটি ক্ষয় রোধ হয়, তেমনিভাবে অতিরিক্ত খরার সময় রোদের তীব্রতায় লবণের হাত থেকে গাছগুলো কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে। ঘাস তৈরি হলে প্রাণী সম্পদের খাদ্যের উৎস্য তৈরি হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন পদ্মপুকুর ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য মো. আশরাফ হোসেন। গাছের বিকল্প কিছু নেই, গাছ পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি দৈনন্দিন জ্বালানি সমস্যা সমাধান করে। সর্বোপরি নদী ভাঙন রোধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে মানুষ ও প্রাণীকে রক্ষা করে বলে স্থানীয় মানুষরা জানান। এই কারণে তারা সম্মিলিতভাবে রোপণকৃত গাছের চারাগুলো বাঁচানোর জন্য পরিচর্যাসহ নানান উদ্যোগ নিয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে।
বনায়নের উপজাত (বাইপ্রোডাক্ট) ধানী ঘাস: জ্বালানি সঙ্কট নিরসনে রাখছে ভূমিকা
পদ্মপুকুর গ্রামের মুর্শিদা বেগম বলেন, “বারসিক নদীর চরে গাছ লাগানোর জন্য ঘেরার উপকরণ সহায়তা করেছিল। আমরা নিজেরাই ঘেরার কাজ সম্পন্ন করি। চরে ম্যানগ্রোভ (লবণ সহনশীল) প্রজাতির গাছ লাগাই। গাছ লাগানোর পর থেকে চর এলাকায় জন্ম নেয় ধানী ঘাস। এই ঘাস আমাদে জ্বালানি সমস্যা সমাধান করছে।” গত দুইবছর ধরে বনায়নকৃত এলাকায় এসব ঘাস জন্মাচ্ছে। স্থানীয়দের মতে, গাছ লাগানোর পর এই ধানী ঘাস জন্ম নেওয়ায় তাদের সুবিধা হয়েছে। কারণ ধানী ঘাস একাধারে তাদের জ্বালানি সঙ্কট দুর করেছে তেমনিভাবে এই ঘাস রোদে শুকানোর পর ঘরের ছাউনি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। ধানী ঘাস রোদে শোকানোর পর বাঁশের কঞ্চির মত শক্ত হয়। আইলার পর থেকেই পদ্মপুকুর ইউনিয়নের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জ্বালানির সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। পরিবারের নিত্য জিনিসের মতো তাদেরকে জ্বালানি কাঠও কিনতে হয় সারাবছর। তবে বনায়নকৃত নদীর চরে জন্মানো এই ধানী তাদের জ্বালানি সঙ্কট কিছুটা হলেও সমাধান করেছে।
উপসংহার
সবুজ বেষ্টনী তৈরির প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে শ্যামনগর উপজেলার সামাজিক বনায়ন কর্মকর্তা এম.এম মিজানুর রহমান বলেন,“জীবনের জন্য বৃক্ষ যেমন অপরিহার্য তেমনি সম্পদ হিসেবে বৃক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিক বৃক্ষ মানে অধিক বৃষ্টি, অধিক ফসল, অধিক সমৃদ্ধি। বৃক্ষ নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। বৃক্ষ রোপণ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে এ প্রাকৃতিক সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিপুল সম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব।” গাছ রোপণের প্রয়োহনীয়তা উপলদ্ধি করে পদ্মপুকুর ও পাখিমারা গ্রামের শফিউল আযম, এয়াকুব গাজী,কোরবান গাজী, মিজানুর, রেজাউল, আমিনুর, রহিম, সবুর, জাফুর, ইউনুস, রশিদ, রাজ্জাক, মনতেজ, সুলতান, শামছুর, কামরুল ইসলাম, নুরু ইসলাম, রুহুল আমিন নিজেরাই বাড়ির সামনে বাঁধের পাশে নিম, তেঁতুল, বাবলা, শিশুফুল, পরশপেপুল, খেঁজুর, তাল, চিরচিড়ে ও খদি গাছ লাগিয়েছেন। উপকূলীয় পদ্মপুকুর জনগোষ্ঠীর অভিযোজন ও প্রশমনে সবুজ বন তৈরির কর্মউদ্যোগকে সহায়তা করছে উপজেলা সামাজিক বন বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ এবং গবেষণা সংগঠন বারসিক। বলা যায়, প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় নদীর বাঁধ রক্ষায় চর বনায়নে জেগে উঠেছে উপকূলীয় এই দ্বীপ জনপদের জনগোষ্ঠী।