নাছিমা আক্তার’র পরিবেশবান্ধব মাটির চুলা বিতরণ
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
গ্রামের নারীদের প্রতিদিনের বেশির ভাগ সময়ই কেটে যায় জ্বালানি সংগ্রহে। বিশেষভাবে লাকড়ি, শুকনা পাতা, খড়, ঘুটে তৈরি ইত্যাদি জ্বালানি সংগ্রহে। মাটির উন্নত চুলা উদ্ভাবনে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তেমন কোন উদ্যোগ না থাকায় এবং প্রচলিত চুলা ব্যবহারের ফলে জ্বালানির পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে তেমনি গ্রামের নারীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে প্রতিনিয়ত। নেত্রকোনা সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নে মনাং গ্রামের কৃষাণী জ্বালানি সাশ্রয়ী মাটির চুলার কারিগড় নাছিমা আক্তার জ্বালানি সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব চুলা উদ্ভাবনে গ্রামীণ নারীদের উদ্বুদ্ধকরণ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
৩৩ বছর বয়সি নাছিমা আক্তারের স্বামী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেসহ ৫ জনের সংসার। স্বামী দিন মুজুরের কাজ করে যে পরিমাণ উপার্জন করেন তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে। কিন্তু নাছিমা আক্তার খুব সাহসী ও বুদ্ধিমতী। তিনি সব সময় পরিবেশবান্ধব কাজকে পছন্দ করেন। তিনি প্রতিবছর ফলের গাছ সংগ্রহ করে বাড়ি চারপাশে রোপণ করেন। নিজের জমি না থাকায় অন্যের জমিতে সারা বছর বিষমুক্ত সবজি চাষ এবং বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে থাকেন। তিনি সংগঠনের সভায় পরিবেশবান্বব চুলা তৈরি ও ব্যবহার বিষয়ে আলোচনার ফলে সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামে একটি চুলার মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বারসিক’র সহযোগিতায় মনাং গ্রামের নারীরা ও কুসুমকলি কৃষাণী সংগঠন ‘কার্বন নিঃসরণ রোধ করি, নির্মল পরিবেশ গড়ি’ স্লোগানকে সামনে রেখে দিনব্যাপী এক চুলা তৈরি প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে। মেলার মূল উদ্দেশ্য ছিল, স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব মাটির চুলা উদ্ভাবনের মাধ্যমে রান্নার ফলে নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ হ্রাস করা এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব চুলার বিষয়ে প্রচারণার মাধ্যমে গ্রামের সকল জনগোষ্ঠীকে পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা। মেলা ও প্রদর্শনীতে মনাং গ্রামে সকল বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
মেলায় নাছিমা আক্তার নিজে পরিবেশবান্ধব ছয় ধরণের চুলা তৈরি করে প্রদর্শন করেন। তাঁর তৈরি করা ও প্রদর্শিত চুলাগুলো হল- নৌকা চুলা, তোলা চুলা, ফাঁসিকাটা চুলা, গোলমূখী চুলা, চারকোনা চুলা, বন্ধু চুলা। মেলায় পরিবেশবান্ধব চুলা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান, চুলা প্রদর্শনী এবং ঘরে ঘরে গিয়ে চুলাগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া শাক রান্না করে ধোয়ার পরিমাণ, জ্বালানির পরিমাণ ও রান্নার সময় পর্যবেক্ষণ করা হয়। পর্যবেক্ষণ করে যেসব চুলায় ধোঁয়া কম হয়, জ্বালানি কম লাগে, হাড়ি কালো হয় না ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে সকলের মতামতের ভিত্তিতে ৩টি চুলাকে পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী হিসেবে নিবার্চন করা হয়। নাছিমা আক্তারের তৈরীকৃত নৌকা চুলাটি মেলায় বেশি জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব চুলা হিসেবে প্রথম স্থান লাভ করে। মেলা শেষে নাছিমা আক্তার মনাং গ্রামের সকলকে কম কার্বন নিঃসরণে উদ্বুদ্ধকরণে কুসুমকলি কৃষাণী সংগঠনের ২৫ জন সদস্যকে ২৫টি পরিবেশবান্ধব নৌকা চুলা বিনামূল্যে বিতরণ করেন। মনাং গ্রাম ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে কাইলাটি ইউনিয়নের দরুনবালি গ্রামের একশত জন নারীকে ১০০টি নৌকা চুলা বিতরণ করেছেন। এভাবে তিনি দরুনবালি ও মনাং গ্রামকে কম কার্বন নিঃসৃত পরিবেশবান্ধব গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে চান।
করোনার পরিস্থিতিতে গ্রামের নারীরা মানুষের বাড়ি থেকে লাকড়ি, বন ও খড় সংগ্রহ করতে পারেন না। খাবার তৈরির জন্য লাকড়ির সংকটে পড়ছিল গ্রামের নারীরা। এই সংকটে নাছিমা আক্তার ২০টি পরিবেশবান্ধব নৌকা চুলা তৈরি করে গ্রামের ২০টি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করেন। তিনি গ্রামে প্রচলিত চুলা ব্যবহারে অধিক জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা, রান্না বসিয়ে অন্য কোন কাজ করতে না পারা, অধিক ধোঁয়ার ফলে নারী স্বাস্থ্যের সমস্যা ও জ্বালানি খরচ বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে নারীদের সচেতন করেন। অন্যদিকে অধিক ধোঁয়ার ফলে নারীদের পাশাপাশি শিশুরাও যে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে সে সম্পর্কেও তিনি সকলকে সচেতন করেন।
নাছিমা আক্তার উদ্ভাবিত নৌকা চুলাটি জ্বালানি সাশ্রয়ী, রান্নায় কম সময় লাগে, ধোঁয়া খুবই কম হয়, রান্নায় বসিয়ে অন্যান্য কাজ করা যায়, সহজে বহনযোগ্য এবং এক সাথে অনেক লোকের রান্না করা যায় এবং সব ধরণের জ্বালানি ব্যবহার করা যায়। তিনি আগ্রহী নারীদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে নৌকা চুলা ও গোলমূখী চুলা তৈরিতে সহযোগিতা করেন।
নাছিমা আক্তারের মতে, এসব চুলা প্রত্যেক গ্রামে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে কার্বন নিঃসরণ যেমন হ্রাস করা সম্ভব হবে, তেমনি জ্বালানি সংগ্রহবাবদ নারীদের সময় সাশ্রয় হবে, জ্বালানি খরচও সাশ্রয় হবে, নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে এবং পরিবেশ সুন্দর থাকবে। রান্না বসিয়ে নারীরা সংসারের অন্যান্য কাজ করতে পারবেন এবং রান্নাবাবদ সময় সাশ্রয় হবে। আমরা পাব একটি কার্বনমুক্ত ও পরিবেশ সমৃদ্ধ একটি গ্রাম।