সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলা শুরু ১৬ সেপ্টেম্বর
বাহলুল করিম, সাতক্ষীরা থেকে
আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে সাতক্ষীরার চারশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলা। সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় সামাজিক ও লোকজ এই উৎসব চলবে মাসব্যাপী। গতকাল বেলা ১১টায় সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তরফদার মাহবুবুর রহমান, সিভিল সার্জন ডা. তাওহীদুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মেরিনা আক্তার ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তহমিনা খাতুন।
সভায় জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলা ১লা আশ্বিন ৩০ দিনব্যাপী গুড়পুকুর মেলার উদ্বোধন হবে। গত বছরের মতো মেলার লোকেশন একই থাকবে। মেলা প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে। রাত ৯টার পরে অবশ্যই মেলার কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। মেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকবে। মেলায় পৌরসভার পক্ষ থেকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পূজা ম-পের পাশে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। পৌরসভা কর্তৃক মেলার প্রতিটি স্টল থেকে যে টাকা ফি হিসেবে ধার্য করা হয়েছে তার যথাযথ হিসাব রাখতে হবে। সব মিলিয়ে আমরা গত বছরে একটি সুন্দর মেলা উপহার দিতে পেরেছিলাম। আশা করি এবারও সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
মেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘মূল পূজার জায়গাটা খুব নোংরা থাকে। এই জায়গাটা আপনাদের পক্ষ থেকে পূজার উপযোগী করে তৈরি করবেন। গতবার গুড়পুকুরের মেলাটা ভাল জমেছিল। রাত ৯টার পরে মেলার কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। কেননা মেলায় অনেক মানুষের সমাগম ঘটে থাকে। সকলের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমাদের টিম সব জায়গায় নজরদারিতে থাকবে। মেলার যাবতীয় আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের। মেলায় আগত সকলকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমরা সবকিছু করবো। গতবারে মেলায় কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আশা করি এবারও সকলের প্রচেষ্টায় একটি সুন্দর মেলা অনুষ্ঠিত হবে।’
সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক আনিছুর রহিম, প্যানেল মেয়র কাজী ফিরোজ হোসেন, পৌরসভার সচিব সাইফুল ইসলাম বিশ্বাস, পৌর কাউন্সিলর শফিক-উদ্দৌলা সাগর, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মনোরঞ্জন মুখার্জী, জেলা মন্দির কমিটির সভাপতি বিশ^নাথ ঘোষ পুরাতন সাতক্ষীরার ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুস সেলিম, শিল্পকলা একাডেমির সদস্য সচিব মুশফিকুর রহমান মিল্টন, রঘুজিত গুহো, জাহাঙ্গীর হোসেন কালু, গোষ্ঠ বিহারী প্রমুখ।
সভায় জানানো হয়, বিশ্বকর্মা পূজা উপলক্ষে অনুষ্ঠিতব্য এই মেলা সাতক্ষীরার চারশ’ বছরের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ বছরও জাকজমকপূর্ণ পরিবেশে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার উদ্যোগে মেলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলায় জুয়া, হাউজি, লটারি, র্যাফেল ড্র, লাকিকূপন, ফড়, চরকি, নগ্ন নৃত্য, অনুমোদিত যাত্রাগান ও পুতুল নাচ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে। মেলার স্থানে ২০টি গণ শৌচাগার নির্মাণ করা হবে। খুলনা রোড মোড় হতে ইটাগাছা বাজার পর্যন্ত ও লাবণী মোড় হতে রাজ্জাক পার্ক পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত না করে মেলার স্টল স্থাপন করা যেতে পারে। লৌহজাত দ্রব্য, বাঁশ ও বেতের দোকান পলাশপোল স্কুলের পাশে বসবে। পলাশপোল স্কুল থেকে খুলনা রোড পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে নার্সারির দোকান বসবে। শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে মনোহারির দোকান বসবে। শিল্পকলা একাডেমির সামনে নাগরদোলা ও রেলগাড়ি বসবে। শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির দোকান বসবে। রাজ্জাক পার্কে অবস্থিত প্রত্যেক ব্যবসায়ীর নিকট থেকে মেলা পরিচালনার খরচ বাবদ ট্যাক্স হিসেবে সাতক্ষীরা পৌরসভা পাকা রশিদের মাধ্যমে ২০০ টাকা উঠাতে পারবে। পার্কের বাইরে অন্যান্য স্থানে যারা দোকান দেবেন তাদের ৩০ দিনের ব্যবসা পরিচালনার অথরিটি হিসেবে পৌরসভা কর্তৃক একটি প্রত্যয়ন পত্র দেবে ও খরচ বাবদ প্রতি দোকানের নিকট থেকে ২০ টাকা গ্রহণ করা হবে। গুড়পুকুরের পাশে পূজাম-পের স্থানে গেটসহ স্টেজ ও পাকাপোলের মোড়ে মেলার অনুষ্ঠান বিষয়ে প্রচারের জন্য একটি গেট নির্মাণ করা হবে। শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের সামনে একটি মেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হবে। মেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হবে।
সভায় আরও জানানো হয়, মেলায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হবে। মেলায় প্রতিদিন আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ ফোর্স নিয়োগসহ রাস্তায় যানজট নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হবে। পৌর মেয়র আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশের পাশাপাশি আনসার ও ভিডিপি সদস্য, স্কাউট, রোভার স্কাউট ও স্থানীয় যুবকদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করবে। মেলা চলাকালীন প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে। মেলা চলাকালীন সিনেমা হলগুলোতে নজরদারি বৃদ্ধি করা হবে। মেলায় আগতদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করা হবে। মেলায় অবৈধ কার্যক্রম রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। মেলা চলাকালীন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মেলা চলাকালীন সন্ধ্যার পর সীমিত এবং সহনীয় শব্দে মাইক ও বাজনা বাজাতে হবে, যাতে পার্শ্ববর্তী কারোর কোনো প্রকার বিঘœ সৃষ্টি না হয়।
প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরার চারশ’ বছরের ঐতিহ্য গুড় পুকুরের মেলা নিয়ে নানা রকম জনশ্রুতি আছে। কেউ বলে, মোগল আমলে একজন রাজকর্মচারী আজকের সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলের মনসাতলায় (বটবৃক্ষতলে) বিশ্রাম নিতে গিয়ে তন্দ্রাছন্ন হয়ে পড়েন। দিনটি ছিল বাংলা সনের ৩১ ভাদ্র। হঠাৎ তিনি জেগে দেখেন, একেবারে কাছেই একটি সাপ ফণা তুলে তাকে ছায়া দিচ্ছে যাতে ঘুমাতে পারেন। সেই থেকে তিনি ওই বটতলায় সাপের দেবী মনসার উদ্দেশ্যে পূজা শুরু করেন এবং অন্যদেরও মনসা পূজা করতে বলেন। এ পূজার প্রসাদ পুকুরে ফেলে দেয়ায় এর পানি মিষ্টি হয়ে যায়। এ কারণে ওই পুকুরের নাম হয়ে যায় গুড়পুকুর।
অন্যরা বলেন, পুকুরে বেশি দিন পানি থাকত না। পরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে স্থানীয়রা সেখানে ১০০ ভাড় গুড় ঢেলে দিলে পুকুরে পানি ওঠে, তাই এমন নামকরণ। আবার শোনা যায়, আশপাশের খেজুর গাছের রস থেকে গুড় তৈরির পর তা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থেই পুকুরটি খনন করা হয়েছিল। আরেকটি মত হচ্ছে, গৌর বর্ণের ব্রাহ্মণরা পুকুরটির মালিক ছিলেন। এ থেকেই গৌরদের পুকুর। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় গুড়পুকুর।
নামের শানে-নজুল যা-ই হোক, পুকুরের নামেই মেলা হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে হয়ে আসছে মনসা ও বিশ্বকর্মা পূজাও। এলাকার অনেকেই বলেন, ওই দুই পূজা ঘিরেই মূলত গুড়পুকুর মেলা। যা সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় সামাজিক ও লোকজ উৎসব।