সাম্প্রতিক পোস্ট

সাতক্ষীরার চারশ বছরের ঐতিহ্য- গুড়পুকুরের মেলা

:: শেখ তানজির আহমেদ, সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরার চারশ বছরের ঐতিহ্য- গুড়পুকুরের মেলাজনশ্রুতি আছে নানা রকম। কেউ বলেন, মোগল আমলে একজন রাজকর্মচারী আজকের পলাশপোলের মনসাতলায় (বটবৃক্ষতলে) বিশ্রাম নিতে গিয়ে তন্দ্রাছন্ন হয়ে পড়েন। দিনটি ছিল বাংলা সনের ৩১ ভাদ্র। হঠাৎ তিনি জেগে দেখেন, একেবারে কাছেই একটি সাপ ফণা তুলে তাকে ছায়া দিচ্ছে যাতে ঘুমাতে পারেন। সেই থেকে তিনি ওই বটতলায় সাপের দেবী মনসার উদ্দেশ্যে পূজা শুরু করেন এবং অন্যদেরও মনসা পূজা করতে বলেন। এ পূজার প্রসাদ পুকুরে ফেলে দেয়ায় এর পানি মিষ্টি হয়ে যায়। এ কারণে ওই পুকুরের নাম হয়ে পড়ে গুড়পুকুর।

অন্যদিকে অন্যরা বলেন, পুকুরে বেশি দিন পানি থাকত না। পরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে স্থানীয়রা সেখানে ১০০ ভাড় গুড় ঢেলে দিলে পুকুরে পানি ওঠে, তাই এমন নামকরণ। আবার শোনা যায়, আশপাশের খেজুর গাছের রস থেকে গুড় তৈরির পর তা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থেই পুকুরটি খনন করা হয়েছিল। আরেকটি মত হচ্ছে, গৌর বর্ণে ব্রাহ্মণরা পুকুরটির মালিক ছিলেন। এ থেকেই গৌরদের পুকুর। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় গুড়পুকুর। নামের শানে-নজুল (প্রেক্ষাপট) যা-ই হোক, পুকুরের নামেই মেলা হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে হয়ে আসছে মনসা ও বিশ্বকর্মা পূজাও। এলাকার অনেকেই বলেন, ওই দুই পূজাকে ঘিরেই মূলত গুড়পুকুর মেলা। সাতক্ষীরার সবচে বড় লোকজ উৎসব এটি।

বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনীর প্রেক্ষাপট ছুঁয়ে গেছে বন কেটে আবাদ হওয়া জনপদ সাতক্ষীরাকে। এখানে দেখা মেলে গোদাঘাটের, সর্পদষ্ট স্বামীকে নিয়ে জলপথে যাবার কালে বেহুলার যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেই গোদা পাটানির ঠিকানা। অদূরে রয়েছে বেহুলার ঝাড়। কাজেই সর্পশঙ্কুল সাতক্ষীরায় দেবী মনসার ভজনা কত বেশি লোকজ ও ঐতিহ্যবাহী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মনসার পূজাটি হিন্দু (সনাতন) ধর্মাবলম্বীদের হলেও মেলাটি কিন্তু সাতক্ষীরাবাসীর। এজন্যই ঈদ বা পূজা-পার্বণের মতো গুড়পুকুর মেলাও এখানে বিরাট এক উপলক্ষ। এ সময় জামাইকে নিমন্ত্রণ করেন স্থানীয়রা। মেয়েকে আনেন নাইওর। বছরের অন্য পার্বণে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসতে না পারলেও গুড়পুকুরের মেলার সময় মেয়েরা বাবার বাড়ি আসবেই। মূল আয়োজনটি একদিনের, ভাদ্র মাসের শেষ দিন। তবে গুড়পুকুরের মেলা চলে এক মাস অবধি। আবহমানকাল ধরে চলে আসা এ মেলায় পসরা সাজাতে একসময় ঢাকা ও কলকাতার পাশাপাশি বিলেতি ব্যবসায়ীরাও সমবেত হতেন বলে কেউ কেউ জানান। মেলা ঘিরে একসময় উৎসবের আমেজ বয়ে যেত সাতক্ষীরায়। এ মেলা মূলত সনাতন ধর্মালম্বীদের দুটি পূজাকে কেন্দ্র করে হলেও সেটি এ জনপদের মানুষের কাছে অসাম্প্রদায়িতার সেতুবন্ধনে পরিণত হতো। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত সাতক্ষীরার গুড়পুকুর মেলা। কোটি কোটি টাকার কেনাবেচা হতো মেলায়। বিশেষ করে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, বেত ও বাঁশের পণ্যের পাশাপাশি সাতক্ষীরার বিভিন্ন ফলদ, ঔষধি ও কাঠজাতীয় গাছের চারার চাহিদা ছিল উল্লেখযোগ্য। মেলা শুরুর ১৫-২০ দিন আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার ও অন্যান্য যানবাহন বোঝাই করে তাদের মালপত্র নিয়ে আসতেন। পলাশপোলের মনসাতলা থেকে শুরু হলেও সাতক্ষীরা শহরের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় মেলা বসত। শহর ছেড়েও অনেক দূর থেকে শোনা যেত মেলার গমগম আওয়াজ।

মেলায় যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ, নাগরদোলা ও জাদু খেলার আয়োজন থাকত খুবই জমজমাট। তাছাড়া সারি সারি ভ্রাম্যমাণ মিষ্টির দোকানে বিক্রি হতো রসমন্ডি, পানতোয়া ও ছানা-সন্দেশ। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা অন্যান্য কেনাকাটা শেষে মিষ্টি না কিনলে যেন তাদের কেনাকাটায় অপূর্ণতা রয়ে যেত।

সাতক্ষীরার চারশ বছরের ঐতিহ্য- গুড়পুকুরের মেলাগুড়পুকুরের মেলায় যেন এক যুগ ধরে গ্রহণ লেগেছে। ২০০২ সালে মেলা চলাকালে শহরের একটি সিনেমা হলে এবং সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত সার্কাসের প্যান্ডেলে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এরপর ছয় বছর বন্ধ থাকে মেলা। ২০০৯ সাল থেকে আবারো শুরু হয়েছে সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ জনপদের মানুষের প্রাণের এ মেলা। কিন্তু মানুষের উচ্ছ্বাস তো বেলুনের মতো। ফুটো করে হাওয়া বের করে দিলে আবার কি আগের মতো উড়তে পারে? বোধ করি এজন্যই স্রেফ এক দশকের ব্যবধানে হারিয়ে যেতে বসেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড়পুকুর মেলা। আগের সেই লোক গিজগিজ সরগরম গুড়পুকুর মেলা যেন এখন অতীত। এখনো বাংলা সনের ৩১ ভাদ্র এলে স্থানীয় প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মেলার উদ্বোধন করা হয়। তাও আবার একটি ছোট্ট পার্কের মধ্যে। অথচ এক দশক আগেও কমতি ছিল না মেলার আয়োজনে। জঙ্গি হামলা ও বেপরোয়া চাঁদাবাজির পরিণতিতে ঐতিহ্যবাহী মেলাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

এবারও গত ১৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা শহরের শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে ঐতিহ্যবাহী এ মেলা উদ্বোধন করা হয়েছে। তবে, পার্কেই সীমাবদ্ধ মেলার পসরা, নাগরদোলা, বাচ্চাদের বিভিন্ন রাইড। মেলার এ হতদরিদ্র রূপ দেখে সাতক্ষীরার পাথরঘাটার মনোরঞ্জন ঘোষ যেমন বললেন, কয়েক বছর আগেও জমজমাট ছিল মেলা। তখন দেখেছি, শহরের লাবণী মোড় থেকে শুরু করে ইটাগাছা মোড় পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসত কাঠের ফার্নিচারের দোকান, ইটাগাছা মোড় থেকে বাকাল মোড় পর্যন্ত কেনাবেচা হতো বিভিন্ন ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা। তাছাড়া শহরের মধ্যভাগজুড়ে থাকত মনিহারি মালপত্রের পাশাপাশি বাঁশ, বেত, লোহালক্করের তৈরি দা, বঁটি, খুন্তা, কুড়াল ইত্যাদি। সাতক্ষীরাসহ আশপাশের সাধারণ মানুষ বহুকাল ধরে তাদের সংসারের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রসহ অন্যান্য মালপত্র বছর শেষে গুড়পুকুর মেলা থেকেই কিনতেন। এখন আর সেদিন নেই। গুড়পুকুরের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে যেন অবাক হওয়ার বিষয়। তারা এ মেলার বর্ণনা শুনলে বিস্ময় প্রকাশ করে। গুড়পুকুরের মেলার সঙ্গে গোপালগঞ্জ জেলার মনিহারি ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাকের পরিচয় চার দশকের। গুড়মেলায় এক মাস বেচাকেনা করলে অন্তত ছয় মাস চলে যেত তার সংসার। কিন্তু কয়েক বছর ধরে গুড়পুকুর মেলায় মালপত্র নিয়ে এসে লাভ করা যায় না। বিভিন্ন চাঁদা ও জায়গা ভাড়া দিয়ে অনেকটাই শূন্য হাতে ফিরতে হয়। তারপরও ভাদ্র মাস এলেই গুড়পুকুর মেলায় আসার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন এ প্রবীণ ব্যবসায়ী।

happy wheels 2

Comments