জয়দেবের অতিথিশালায় ভোরের পাখি
:: দেবদাস মজুমদার, বিশেষ প্রতিনিধি, উপকূল অঞ্চল
ভোরের আকাশে তখনও সূর্য উঁকি মেলেনি। শহরশুদ্ধ মানুষের রাতের ঘুমের ঘোর কাটেনি। কেবল ঘুম ভাঙে পাখি প্রাণ জয়দেবের। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির কিচির মিচির শব্দে জেগে ওঠেন তিনি। বিছানা ছেড়ে ত্রস্ত পায়ে সদর রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়। তাঁর আগেই দল বেঁধে ভোরের পাখিরা আসে। দিনের শুরুর আহারের আশায় এখানে চলে পাখির সমাবেশ। পাখি প্রেমী জয়দেবের চারপাশে তখন পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সকাল বেলা পাখির ডাক ছাপিয়ে যায় শহরময়। আশপাশের মানুষের যেন সকালের ঘুম ভাঙে পাখিদলের কিচির মিচির ডাকে। এ যেন ভোরের পাখির মিলন মেলা; যেন অতিথি হয়ে আসে। এরপর পাখিসখ্য জয়দেব এসব পাখিদের নিজের হাতে তৈরি খাবার ছড়িয়ে দেন। অতিথি আপ্যায়নের মতোই চলে সকালের এ খানাপিনা। গত পাঁচ বছর ধরে পাখিদের এভাবে খাবার দিয়ে চলেছেন তিনি। জয়দেবের দেওয়া খাবার খেতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে শালিক, কবুতর ও কাক। ছোট পাখি চড়ুই আর দোয়েলেরাও আসে। শত শত পাখিকে রোজ ভোরে জয়দেব পরম যত্নে খাবার দেন। তখন মুগ্ধ মায়াবী প্রাণের মেলা বসে সড়কজুড়ে।
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা শহরের দক্ষিণবাজার সরকারি বালক বিদ্যালয় এলাকার সড়কে রোজ ভোর বেলায় বসে পাখির এমন অতিথিশালা। স্থানীয় রেষ্টুরেন্ট ব্যবসায়ী গোবিন্দ রায়ের কলেজ পড়–য়া ছেলে জয়দেব রায় প্রতি ভোরবেলা কয়েক হাজার পাখিকে পরম মমতায় খাবার দেন। প্রতিদিন ভোর বেলায় ঘণ্টাব্যাপী নির্বিঘ্নে এখানে পাখিদের আহার চলে। ভোরের নিস্তবতা কাটিয়ে পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারিধার। পাখির প্রতি জয়দেবের এমন ভালোবাসা স্থানীয় মানুষের কাছেও বেশ উপভোগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলেজপড়ুয়া জয়দেবকে এলাকার ছোটরা ভালোবেসে পাখিদা কেউ পাখিপ্রাণ কেউ আবার পাখিসখা বলে বলে ডাকে।
পাখিপ্রেমী জয়দেব জানান, পাঁচ বছর আগে তাঁর বাবা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী গোবিন্দ রায় সকালে দোকানের আশপাশে বিচরণ করা পাখিকে খাবার দিতেন। জয়দেবের খুব ভালো লাগত বিষয়টা। একদিন জয়দেব নিজেই ভোরের নিরব সড়কে পাখিদের খাবার ছড়িয়ে দিলে শত শত পাখির মিলন মেলা বসে। অভিভূত জয়দেবকে এটা একসময় নেশা ধরিয়ে দেয়। ভোরের পাখিদের খাবার দিতে দিতে জয়দেব খুব সুখ পান। এখন প্রতিদিন ভোর বেলা কয়েক হাজার পাখিকে খাবার দিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
তিনি জানান, এক সঙ্গে এত পাখির প্রতিদিন ভোরে খাওয়ানোর জন্য আগের দিন রাতে প্রস্তুতি নিতে হয়। জয়দেবের পরিবারের স্বর্ণচূড়া রেস্টুরেন্টে তৈরি হয় পাখির খাবার। পরোটা রুটি ইত্যাদি আলাদা করে ভেজে রাখে দোকানের কর্মচারীরা। প্রতিদিন কাজ শেষে রাতে পাখির খাবার তৈরি করে রাখা হয়। তারপর জয়দেব রোজ ভোরে খাবার দিয়ে পাখির মিলন মেলা ঘটান।
পাখিসখ্য প্রাণ জয়দেব বলেন, “পাখির প্রতি ভালোবাসা ও মানুষ হিসেবে একটা দায় থেকেই পাখিরে আহার দেই। দিনভর পাখিরা যদিও প্রকৃতি থেকে খাবার সংগ্রহ করে বাঁচে তবে সকালের খাবার খেতে ওরা আমার কাছে আসে। এটা একটা মায়া অনেক বড় একটা সুখ।”
এ বিষয়ে কাউখালীর শিক্ষক ও সংস্কৃতিজন সুব্রত রায় বলেন, “পাখিপ্রাণ জয়দেবের এমন মহতী কর্ম থেকে আমাদের শেখার আছে। এ শুধু পাখি প্রেম নয় মানুষেরও অধিক কিছু কাজ যেমন আমাদের অনুপ্রাণিত। জয়দেবরা আছে বলে হয়তো আমাদের প্রাণবচিত্র্য টিকে আছে।”