কাঁঠালে অজ্ঞাত রোগের আক্রমণ: ক্ষতিগ্রস্ত মধুপুরের কৃষকরা
মধুপুর থেকে ফিরে শংকর ম্রং
বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। পুষ্টিগুণে ভরপুর ও সুস্বাদু এই ফল মানুষসহ সকল প্রাণীর নিকট খুবই প্রিয়। জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে কাঁঠাল পাকা আরম্ভ করে আষাঢ় মাস পর্যন্ত ব্যাপকভাবে কাঁঠাল পাওয়া যায়। তবে শ্রাবণ মাসেও কাঁঠাল বাজারে মেলে। কোন কোন গাছে ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও কাঁঠাল পাওয়া যায়। আবার কিছু কিছু গাছে বছরব্য্যাপী কাঁঠাল ধরে। বছরব্যাপী যেসব গাছে কাঁঠাল পাওয়া যায় তাকে বারমাসী কাঁঠাল বলা হয়। বাংলাদেশে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা ও টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরে কাঁঠালের ব্যাপক চাষ হয় এবং ফলেও অধিক। তবে বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশের সর্বত্র (হাওরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চল ব্যতীত) কাঁঠালের চাষ লক্ষ্য করা যায়। কাঁঠাল গাছের তেমন কোন পরিচর্যা করতে হয় না। শুধুমাত্র চার ফুটের বেশি উচ্চতার চারা রোপণ করে গরু-ছাগলের আক্রমণ থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করলেই বেশ। কাঁঠালের মৌসুম শেষে বছরে একবার গাছের অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ও ফলের বোটাগুলো ছেটে দিলেই হলো। পানি সেচ বা কোন ধরণের সার বা কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় না। বলা চলে, কাঁঠাল দেশের একমাত্র ফল যা’ রাসায়নিকসার ও কীটনাশকমুক্ত ও নিরাপদ। তবে কৃষকের হাত থেকে কাঁচা কাঠাল পাইকারদের হাতে হাত বদল হওয়ার পর অসাদু পাইকাররা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পাঁকানোর জন্য কার্বাইড জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করে থাকে। যদিও এর হার খুবই সামান্য, কেননা এধরণের ঘটনা ঘটে শুধুমাাত্র যেসব পাইকার বা ব্যবসায়ি গ্রামে কাঁঠালের বাগান কিনে একদিনে অনেকগুলো করে (শতাধিক) কাঁঠাল পেড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে বিক্রি করেন। তবে কাঁঠালের ভরা মৌসুমে দৈনিক গাছেই প্রাকৃতিকভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঁঠাল পাঁকাতে কোন ধরণের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করতে হয় না।
একটি গাছে কাঁঠাল ফলেও অনেক। তবে কাঁঠালের এলাকা ভালুকা ও মধুপুর অঞ্চলের কৃষকরা ভরা মৌসুমে কাঁঠালের ন্যায্য মূল্য থেকে বরাবরই বঞ্চিত। জুলাই মাস হল মধুপুর অঞ্চলের কাঁঠালের ভরা মৌসুম। আমার বাড়ি মধুপুর উপজেলার জলছত্র গ্রাামে। মা থাকেন গ্রামে। তাই গ্রামের টানে ও মায়ের টানেই প্রতিমাসে একবারের জন্য হলেও বাড়ি যাই। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে তাই বাড়ি গিয়ে তিনদিন কাটাই। আমার বাড়িতে ফল ধরছে এমন ১২টি কাঁঠালের গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছে কাঁঠাল ধরেছেও অনেক। ছোটবেলাকার অভ্যাসমত সকালবেলা প্রত্যেকটি গাছে কাঁঠাল পেঁকেছে কিনা তা দেখতে বের হই। দেখি প্রায় প্রত্যেক গাছেই এক-দু’টি করে কাঁঠাল পেঁকেছে। কোন কোন গাছে দুই-তিনদিন আগে কাঁঠার পেঁকে পচন ধরেছে, আবার কয়েকটি গাছের নিচে পাঁকা কাঁঠাল পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। দেখতে পাই চারটি গাছের কাঁঠাল অজ্ঞাত রোগের ফলে কাঁচা থাকা অবস্থাতেই পঁচন ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পঁচনের ধরণ এমন, যেন ফাঙ্গাস লেগে পচন ধরেছে। দু’টি গাছের প্রায় সবগুলো কাঁঠাল পচে নষ্ট হয়ে গেছে। গ্রামেরই আমার এক বড় ভাইয়ের বাড়ির ঊঠোনের দু’টি গাছের বড় বড় আকারের সবগুলো কাঁঠাল পচে নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের গাছের কাঁঠালের ন্যায় গ্রামের প্রায় সকল কৃষকের গাছের কাঁঠালে একই ধরণের পচন রোগ ধরেছে বলে গ্রামের কৃষকরা জানান। আমি পচন ধরার আগেই দু’টি গাছের একটি করে দু’টি কাঁঠাল পেড়ে খাাওয়ার জন্য শহরে নিয়ে এসে পাকালাম। কিন্তু কাঁঠাল পাকানোর পর খেতে পারলামনা। ঐ গাছের কাঁঠাল লেউসা (নরম) হলেও পেড়ে পাঁকানো কাঁঠালের কোষগুলো ছিল চাউলা (শক্ত) এবং দেখতে নিলচে। খেতেও যেন স্বাদহীন এবং কচকচ করছিল। যেমনটি হয় গাছের উপর থেকে ফেলে দিয়ে কাঁঠাল পেড়ে পাঁকালে। আরেকটি গাছের কাঁঠাল পাঁকানোর আট দিন পার হলেও তা পাঁকেনি। উপড়ের আবরণটি খুবই শক্ত, অথচ সকল গাছের কাঁঠালই পাঁকতে সময় লাগে সর্বোচ্চ তিনদিন। কিন্তু এ বছর এই গাছের কাঁঠালটি আট দিনেও পাকেনি। অবশেষে শক্ত থাকা অবস্থায়ই আমি কাঁঠালটি দা দিয়ে কেটে দেখার চেষ্টা করি। কাটার পর দেখা যায়, ভেতরে কাঁঠালটি পেকেছে। কোষগুলো বেশ নরম না হলেও তেমন শক্ত নয়। রঙও দেখতে ভালো তবে কোষগুলোর নিচের অংশ ছিল নরম, দেখতে কেমন যেন পচা পচা মনে হয়েছে। তবে কোন গন্ধ নেই, কাঁঠালটির উপরের অংশেও কোন ধরণের পচন ছিলনা। অজ্ঞাত রোগ আক্রান্ত গাছে কাঁঠাল পাঁকলেও কাঠবিরালি, বাদুর, শিয়াল বা অন্য কোন পশু-পাখি তা খাচ্ছে না এবং এমনকি পাকার অনেকদিন পার হলেও ঝড়ে নিচে পড়ছেনা, বরং সেগুলো গাছেই কালো হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত গাছে কাঁঠাল পাকার তিনদিনের মধ্যেই বোটা থেকে ঝড়ে নিচে পরে। কৃষি বিভাগের কোন কর্মী বা কর্মকর্তা কখনো গ্রামে না আসায় এবং সময়ের অভাবে কৃষি অফিসে গিয়ে এই সমস্যার কারণ জানা সম্ভব হয়নি।
গ্রাম থেকে ফিরে শহরে আসার পর আমার এক বন্ধু উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে কাঁঠালের পচনের কারণ জানার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমস্যার বর্ণনা লিখে ও আক্রান্ত কাঁঠালের ছবি পাঠাই। সমস্যার বর্ণনা শুনে এবং আক্রান্ত কাঁঠালের ছবি দেখে তিনি অতিবৃষ্টির জন্য এই পচন রোগটি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন। তিনি জলবায়ুজনিত কারণকেও এর জন্য দায়ি করেন। তবে গ্রামের কৃষকরা তা মানতে নারাজ। কৃষকদের মতে, এবছর কাঁঠালে বদ লোকের খারাপ চোখের নজর লেগেছে, তাই এবছর কাঁঠাল ব্যাপক হারে পচে গেছে। কৃষকদের এধরণের মন্তব্যের কোন বৈজ্ঞানিক গ্রহণযোগ্যতা আছে কিনা জানিনা। আবার কৃষিবিদ বন্ধুর কথামতো যদি অতিবৃষ্টি বা জলবায়ুগত কারণ হয় তাহলে অন্য সব গাছের কাঁঠাল কেন পচেনি এটিও ভাবার বিষয়। বিষয়টি কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীদের জানার বিষয়। কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি সমস্যাটির সঠিক কারণ নির্ণয় করে কাঁঠাল চাষিদের এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার জন্য।
মধুপুরে কাঁঠালে একদিকে পচন রোগ অন্যদিকে কাঁঠালের অস্বাভাবিক কম মূল্যের ফলে কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রতিবছর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা গ্রামে ঘুরে ঘুরে কাঁচা/পাকা কাঁঠাল ক্রয় করে, কিন্তু এবছর গ্রামে পাইকাদের খুব একটা দেখা যায় না বলে জানা যায়। আমার মাকে কাঁচা কাঁঠাল বিক্রি করে দিতে বললে পাইকার আসেনা বলে মা জানান। গ্রামের সব বাড়িতেই কমবেশি কাঁঠাল গাছ রয়েছে, তাই গ্রামের মানুষ বাজার থেকে কাঁঠাল কিনে খায় না। মধুপুরের কাঁঠাল চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। কাঁঠালের দাম এতটাই কম যে, যেসব কৃষকদের গরু রয়েছে তারা কাঁঠাল বিক্রি না করে গরুকে খাওয়াচ্ছে। অনেকে বাজার থেকে কম দামে কাঁঠাল কিনে গরুকে খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। কাঁঠালের এতই দাম কম যে, নেত্রকোণা শহরে যে কাঁঠালের দাম ৬০-৭০ টাকা মধুপুরে (জলছত্র) ঐ আকারের কাঁঠালের দাম সর্বোচ্চ ১০-১২ টাকা। তাই কৃষকরা বিক্রির চেয়ে গরুকে পাকা কাঁঠাল খাওয়ানোকেই উত্তম মনে করছেন। কাঁঠালের মৌসুমে কাঁঠাল খেয়ে গরুও বেশ স্বাস্থ্যবান হচ্ছে।
চলতি মৌসুমে মধুপুর অঞ্চলে কাঁঠালের অজ্ঞাত পঁচন রোগের পুনরাবৃত্তি যাতে আগামী মৌসুমেও না ঘটে সেজন্য কৃষি বিভাগের কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ কামনা করছি। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞগণের সহযোগিতা পেলেই মধুপুর অঞ্চলের কৃষকদের এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।