গাঞ্জিয়ার বিলকুমারী জয়
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
গাঞ্জিয়া কথন
একটি ধান জাতের সাথে মিশে থাকে হাজারো কৃষকের আবেগ, মিশে থাকে হাসি। বিশেষ করে যখন ধানজাতটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থেকে কৃষককে ফলন দেয় বা প্রাকৃতিক দূর্যোগে চাষকৃত সকল ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর জাতটি শেষ ভরসা হয়ে টিকে থাকে। বলছি গাঞ্জিয়া নামের ধান জাতটির কথা। গানঞ্জিয়া ধানের কথা আসলে প্রত্যাশিতভাবেই চলে আসে উত্তরবঙ্গের উত্তরের জেলা গাইবান্ধার চরাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর কথা। সেখানে গাঞ্জিয়া ধান চাষের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, ব্রহ্মপূত্র/যমুনার অনিয়ন্ত্রিত বন্যার কারণে প্রতিবছরই হাজার হাজার বিঘা জমির ধান ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। কখনও ধানগুলো চারা অবস্থায়, কখনও থোর অবস্থায় আবার কখনও পরিপক্ক অবস্থাতেও নষ্ট হওয়ার নজির পাওয়া গেছে। ধান থোর বা পরিপক্ক হওয়ার সময় যদি বন্যায় নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আশ্বিন-কার্তিক মাসে সাধারণত আর আমন ধান রোপণের সময় থাকে না। বা আমনের চলতি ধানজাতগুলো রোপণ করলেও আর ফলন পাওয়া যায় না। ঠিক সে সময়ই গাঞ্জিয়া রোপণ করেন কৃষকরা শেষ ভরসা হিসেবে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে রোপণ করলেও অগ্রহায়ণ মাসের শেষ থেকে পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ধানগুলো পরিপক্ক হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে গাইবান্ধার কালাসোনা চরের কৃষক মো. সোহরাব হোসেন(৪২) বলেন, “গাঞ্জিয়া থেকে তারাতারি ফলন পেতে হলে ১৫-২০দিনের চারা রোপণ করাই উত্তম। গাঞ্জিয়া ধানের কল্যাণেই চরে অনেক অভাব থাকলেও আর ভাতের অভাব হয় না।” কালাসোনা চরের অপর এক কৃষক মো. শফি-আলম বলেন, “এ ধানটি আউশ, আমন ও বোর উভয় মৌসুমেই চাষ করা সম্ভব। সেচেরও তেমন প্রয়োজন হয় না শীত মৌসুমে শিশির থেকে এ ধান পানির চাহিদা মিটিয়ে নেয়।”
গাঞ্জিয়ার বরেন্দ্র যাত্রা
২০১৫ সালের আমন মৌসুমে কালাসোনা “চর বীজ ব্যাংক” থেকে কৃষক-কৃষক বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে এক কেজি পরিমাণ গাঞ্জিয়া ধানটি “বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক”কে আসে। এরপর রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামে স্বল্প পরিসরে ধানটি চাষ হয় ও বীজ বর্ধন করা হয়। দুবইল গ্রামে প্রথম বছরে কেজি পরিমাণ ধান পাওয়া যায়। এরপর দ্বিতীয় বছরে একই এলাকার ৩জন কৃষক ও গোদাগাড়ি উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়নের একজন কৃষক এই ধানটি চাষ করে মোট ২২ মণ ফলন পান। তানোর এলাকায় আমন মৌসুমে কৃষকরে প্রথম পছন্দ হিসেবে চাষ হয় জিরা, ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, সুমন স্বর্না, গুটি স্বর্না জাত। তবে অতীতের তুলনায় ২০১৭ সালের বর্ষা মৌসুমে বরেন্দ্র এলাকায় অধিক ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত হয়। আর এই বৃষ্টিপাতের কারণে তানোর, মান্দা, নিয়ামতপুর, নাচোল, গোদাগাড়ি উপজেলার কিছু অংশের পানি নেমে আসে তানোর উপজেলায় অবস্থিত “বিলকুমারী” বিলে। বিলকুমারীর পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে সৃষ্টি করে বন্যার। তাই সারাদেশের মত এবারেও এখানের বন্যাটি অন্য বছরের তুলনায় বেশি মাত্রায় ফসলের ক্ষতি করে। সর্বশেষ যখন বিলকুমারী বিলে বন্যা আসে তখন এর চারপাশের জমিতে ধানগুলো থোর পর্যায়ে। উপজেলার হাতিশাইল গ্রামের ৪০জন কৃষকের প্রায় ১৩৫ বিঘা ধান বন্যার পানিতে ডুবে থেকে একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকদের এ দূর্যোগ মোকাবেলা করতে হাতে ছিলনা কোন বীজ বা উপায়। তাঁরা কেউ কেউ চিন্তা করছিলেন আর কোন ফসল না করে আগামীতে সরিষা চাষ করা বা বোরো ধানের চাষ। ঠিক সে সময় হাতিশাইল গ্রামের কৃষক মো. হাফিজুর রহমান (৩৬) তানোর উপজেলায় অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ফলদ বৃক্ষ মেলায় বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকের কথা মনে করেন। সেখান থেকে তিনি গাঞ্জিয়া ধানটি সংগ্রহ করে আবাদ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি মেলায় দেখেছিলাম যে সেখানে অনেক প্রকার দেশী ধানের বীজ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মূলত সে কথা চিন্তা করেই আমি দুবইল গ্রামে যোগাযোগ করি এবং গাঞ্জিয়া ধান সম্পর্কে জানতে পারি। পাশাপাশি জানতে পারি এ ধানের চাষ প্রক্রিয়া। এরপর ২০ কেজি পরিমাণ বীজ আমি সেখান থেকে সংগ্রহ করি।” তিনি আরো বলেন, “এবারের বন্যাতে আমার ৭ বিঘা জমির গুটি স্বর্না ধান থোর পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়। তখন আমার সারাবছরের খাবারের ধানের চিন্তায় পড়ি।” এ চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি বীজগুলো সংগ্রহ করার পর একটি রোদ দিয়ে ধানগুলো বীজতলায় বপন করি। এরপর আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময়ে বন্যার কারণে কিছু ধান নষ্ট হয়া জমিতে একটি মাত্র চাষ দিয়ে ২২ দিনের মধ্যে আমার ৪ বিঘা জমিতে চারাগুলো রোপণ করি অনেক আশা নিয়ে।” তিনি বলেন, “এভাবে ধানের শিশ বের হয়। পরিচর্যা বলতে আমি তেমন সার প্রয়োগ করিনি। শুধু থোর পর্যায়ে এসে একটি মাত্র সেচ দিয়েছিলাম। বর্তমানে ধানগুলো কর্তন করা হয়েছে। তিন বিঘা জমির ধান মাড়াই-ঝাড়াই করা হয়েছে ফলন হয়েছে ১৩ মণ ২০ কেজি হিসেবে, যা আমার সারাবছরের খাবারের চাহিদা মেটাবে এবং অন্য কৃষকের বীজের চাহিদা মেটাবে।”
গাঞ্জিয়ার আগামীর সম্ভাবনা
তানোর উপজেলার কামারগাঁ ইউনিয়নের মধ্য হাতিশাইল গ্রামটি পড়েছে। এ গ্রামসহ পাশের মালশিরা, হরিদেবপুর, শ্রীখন্ডা, দমদমা, কচুঁয়া, ঘাঁঙঘাটি, হাতিনন্দা গ্রামের মত অনেক গ্রাম আছে যেখানে জলডোবা জমির পরিমাণ তানোর উপজেলার অন্য গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি এবং সেখানে প্রতিবছরই কম বেশি ধান বন্যায় নষ্ট হয় ও পতিত থাকে। কৃষকের ভাষায় জলডোবা বলতে বৃষ্টি ও বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া জমি, যা শুধুমাত্র বোরো মৌসুমে আবাদযোগ্য হয়। অন্যদিকে আগাম বন্যার কারণে সেই বোরো ধানটিও অনেকসময় নষ্ট হয়ে যায়। চলতি মৌসুমে হাতিশাইল গ্রামে গাঞ্জিয়া ধানের চাষ প্রত্যক্ষ করে হাফিজুর রহমানের কাছ থেকে তাঁর নিজ গ্রামসহ পাশের গ্রামের মোট ৬৩ জন কৃষক আগামী মৌসুমে নিজের জমিতে চাষ করার জন্য বীজের চাহিদা দিয়েছেন। এর মধ্য ৮জন কৃষক মোট ৫৬ কেজি ধান সংগ্রহ করে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে হাতিশাইল গ্রামের মো. সাহাদৎ হোসেন (৪৮),মো. সেলিম রেজা (৪৫), মো. দুলাল মন্ডল(৫০) জানান, বীজ সংকটের বিষয়টি চিন্তা করে তারা কেজি করে বীজ সংগ্রহ করে রেখেছেন। নতুন জাত চাষ হিসেবে গ্রামের প্রবীণ কৃষক মো. মুনসুর রহমান (৬১) বলেন, “জাতটি কম খরচে ভালো ফলন দিয়েছে আমাদের এলাকায় জাতটি খুবই উপযোগী হবে। কারণ ধানটি দেরি করেও চাষ করা যায়। কৃষকরে চাহিদা ও এ ধানের সম্ভাবনা দেখে হাতিশাইল গ্রামের কৃষকরা মনে করছেন আগামী বছরে প্রায় ৮৫-৯০ বিঘা জমিতে এ ধানটি চাষ হবে।