কৃষিতে শর্মা রানীর সফলতা
সাতক্ষীরা থেকে চম্পা রানী মল্লিক
আধুনিক কৃষির প্রচলন, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং বাণিজ্যিক চিংড়ি চাষ বাংলাদেশের উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের অসংখ্য কৃষি পরিবারের এই প্রতিবেশিক বন্ধন বিগত ২/৩ দশক ধরে চরমভাবে ক্ষত-বিক্ষত। শত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে উপকূলীয় কৃষি পরিবারের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন অনেক কৃষি পরিবার। তেমনি এক কৃষি উদ্যোক্তার নাম শর্মা রানী মন্ডল (৪২)। উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামে আধুনিক কৃষির এক মডেল হল এই শর্মা রানী। স্বামী বিমল মন্ডল ও এক ছেলেসহ পরিবারে সদস্য সংখ্যা তিন জন। সংসার চলে মূলত কৃষি কাজ করে। নিজ হাতে তিনি কৃষিকাজ করেন একই সাথে স্বামী ও সন্তান তার এই কাজে সহযোগিতা করেন। কৃষি উদ্যোক্তা শর্মা রানীর সাথে এই বিষয়ে কথা বললে তিনি বলেন, “গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু এগুলো ছিল আগেকার দিনের এক একটি কৃষি বাড়ির চিত্র। এখনও আমার আগের দিনের সেই কৃষির চিত্র মনের কোনায় ভেসে ওঠে। সেই ভালোলাগা থেকেই আমি কৃষি কাজ করি।”
শুরুতেই তিনি নিজের ১৫ কাঠা বসতভিটা ও এক বিঘা বিলান জমিতে কৃষিকাজ এবং বাড়িতে বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি, ফল ফুল ও ঔষধি গাছ লাগাতে থাকেন। তবে ২০১৩ সালে তার মাথায় নতুন চিন্তা আসলো যে, তিনি তার বাড়িকে আরো সুন্দরভাবে সাজাবেন। তাই তিনি একটু একটু করে কাজ করতে থাকেন। নানা পদ্ধতিতে সবজি চাষের উপর বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি কৃষিতে আরো অগ্রসর হতে থাকেন। সেই সাথে তিনি অন্যান্য নারীদেরকে ও উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তিনি বস্তা পদ্ধতিতে, টাওয়ার পদ্ধতিতে, পলিথিনের মধ্যে, দইয়ের মালসার মধ্যে এমনকি ভাঙ্গা বালতির মধ্যেও সুন্দরভাবে সবজি লাগিয়েছেন। এসব পাত্রের মধ্যে ৫-৬ বছর আগের গাছ এখনো বেঁচে আছে। তিনি সারাবছর মৌসুম ভিত্তিক কুশি, ঝিঙ্গা, তরুল, সীম, মিষ্টি কুমড়া, বরবটি, ঢেড়ষ, কামরাঙা ঢেড়ষ, বেগুন, ঝাল, পুঁইশাক , ডেমোশাক, টমেটো, পালংশাক, লালশাক, তরমুজ, ওল, হলুদ, কচুরমূখী, উচ্ছে, লাউ, কলমীশাক,মূলা, ওলকপি, বাঁধাকপি, বীটকপি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ধনচে ও ধান সবজী /ফসল চাষাবাদ করেন। বাড়িতে সব ধরনের বীজ সংরক্ষণ করেন।
শর্মা রানী বলেন, “বর্ষার সময় যখন বাগানে বেশি জল জমে থাকে তখন তো সকল প্রকার সবজি নষ্ট হয়ে যায়,এ সময় আমি বস্তা এবং মালসাগুলো বারান্দায় উঠিয়ে রাখি। এ থেকে আমার কিছুটা সবজি চাহিদা পূরণ হয় এবং বিশেষ করে মরিচের দিক থেকে অনেক উপকার পাই। কারণ এ সময় মরিচের প্রচুর দাম থাকে, কিন্তু আমার মরিচ কেনা লাগে না।” তিনি আর ও বলেন, শুধু বর্ষার সময় নয় আইলার মত ভয়াবহ সমস্যার সময়ে ও গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।” তার কোন গরু না থাকায় তিনি গোবর কিনে জৈব সার তৈরি করে সবজি চাষ করেন। তিনি যে তার সবজি চাষে কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার করতেন না একথা গ্রামের অনেকেই জানতেন এবং জৈব সারে তৈরি সবজির উপকারিতা ও জানতেন। তাই তার সবজি বিক্রির জন্যে বাজারে যাওয়া লাগে না, কারো মাধ্যমে একটু সংবাদ দিলেই যথেষ্ট। তার পরিবারটি মূলত কৃষি এবং সবজি চাষের উপর নির্ভরশীল। শুধু তাই নয়, এর উপরই নির্ভর করে তিনি বিজ্ঞান বিভাগে পড়া একটি মাত্র ছেলের খরচ বহন করছেন। তার এই বিভিন্ন প্রকার সবজি চাষের আগ্রহ এবং সফলতায় ২০১৫ সালে কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর হাত থেকে ক্রেষ্ট ও সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন।
প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ শর্মা রানীর কৃষিবাড়ি উপকূলসহ বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষিঐতিহ্য, অস্তিত্ব, সংস্কৃতি এবং স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রার দিকনির্দেশনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল। সরকারি/ বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ শর্মা রানীর এই জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি উপকূলীয় প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবদান রাখবে।