ভার্মি কম্পোস্ট ফসলের পুষ্টিমান উর্বরতা ও উৎপাদন বাড়ায়
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
পাবনার চাটমোহরের মথুরাপুর ইউনিয়নের ইচাখালী গ্রামে তিন বিঘা জায়গার উপর ৫ জন উদ্যোক্তা প্রজ্ঞা এগ্রো এন্টারপ্রাইজ নামে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল খামার। প্রায় শতাধিক গরু পালনের পাশাপাশি এ খামারে একটি টিনশেড ঘড়ে ২২টি হাউজে তৈরি করা হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট। ১৩ জন শ্রমিকের কর্ম সংস্থান হয়েছে এ খামারে। খামারটির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার শামসুল আলম বলেন, “আমরা দুইবছর পূর্ব থেকে এ খামারে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করে আসছি। মেহেরপুর থেকে থাইল্যান্ডের এবং বগুড়া থেকে অষ্ট্রেলিয়ান কেঁচো নিয়ে এসে প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচটি সেনেটারি রিং স্লাবে সীমিত আকারে ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদন শুরু করি। সাড়ে সাত হাজার টাকায় প্রথমে দশ হাজার কেঁচো আনি।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ার পাশাপাশি বাড়তে থাকে কেঁচোর সংখ্যাও। আমরা হাউজের সংখ্যা দিন দিন বাড়াতে থাকি। সেনেটারি রিংস্লাবের বদলে চার ফিট বাই আট ফিট হাউজ তৈরি করি। চাটমোহর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সুপারভাইজ করেন। পনেরো টাকা কেজি দরে বিক্রি করি আমাদের উৎপাদিত ভার্মি কম্পোস্ট। চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া এবং ফরিদপুর উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমাদের ভার্মি কম্পোষ্ট কিনে বিতরণ করছেন কৃষকদেও মাঝে।”
শামসুল আলম জানান, এছাড়া এ বছর রাজশাহীতে তিন টন সার বিক্রি করেছেন। কৃষি অফিস কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করায় তারাও কিনে নিয়ে যাচ্ছে এ কম্পোস্ট। এ খামারে এ বছর অন্তত ৮টন ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন হবে। ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করার জন্য গরুর গোবর ষাট দিনের অধিক সময় বাইরের হাউজে রাখেন। গোবর গন্ধমুক্ত ও শোধন করার জন্য টাইকোডার্মা স্প্রে করেন। শোধন শেষে হাউজে গোবর দিয়ে এর মধ্যে কেঁচো ছেড়ে দেন। এক একটি হাউজে এক কেজি কেঁচো দেন যা সংখ্যায় প্রায় পঁচিশ হাজারের মতো। অষ্ট্রেলিয়ান কেচো একটু বেশি মোটা হওয়ায় ওজনে বেশি হয়। কেঁচো প্রাকৃতিকভাবে শীতকালে ডিম দেয়। প্রতিটি ডিম থেকে পাঁচ ছয়টি কেঁচো হয়। পঁচিশ থেকে আঠাশ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। তিনি আরও জানান, হাউজে গোবর ও কেঁচো দেবার এক মাস পর চালনায় চেলে সার সংগ্রহ করা হয়। এসময় কম্পোস্ট এর মধ্যে কোঁচোর ডিম থাকলে সেগুলো চালনার সাহায্যে আলাদা করে অন্য কোন হাউজের নিচে কাঁচা গোবর দিয়ে তার উপর রাখা হয়। একেবারে উপরে ও কাঁচা গোবর দিয়ে পেষ্টিং করে দেওয়া হয়। হাউজের আকার ভেদে এক একটি হাউজে দশ মণের মতো শোধন করা গোবর দিতে হয়। একটি হাউজ থেকে প্রতিমাসে প্রায় সারে চার মণ ভার্মি কম্পোস্ট পাওয়া যায়।
প্রজ্ঞা এগ্রো এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক জহুরুল ইসলাম জানান, তিনি নিজে তার জমির রসুন ও ধানে বিঘা প্রতি একশ’ ৫০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট প্রয়োগ করে সফলতা পেয়েছেন। ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারের ফলে অন্য কৃষকের চেয়ে তার জমিতে ভালো ফলন হওয়ায় এখন অন্য কৃষকেরা ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে সচেতনতার অভাবে এবং ভার্মি কম্পোস্ট এর গুনাগুন না জানায় অনেক কৃষক এখনো ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করছেন না। এটি রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে আনছে। এ খামারের ভার্মি সহকারী মহিতুল ইসলাম জানান, দুই বছর যাবত এ খামারে কাজ করছেন তিনি। বেশি গরমে ঘরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পানি স্প্রে করতে হয়। বৃষ্টির সময় হাউজে কখনো কখনো পিঁপড়া ও ডাই (বড় কালো পিঁপড়া) উঠে কেঁচোর ক্ষতি করতে পারে। এছাড়া ইঁদুর, চিকা, ব্যাঙ কেঁচোর বড় শত্রু। এ খামারের ভার্মি সেক্টরে জুয়েল রানা অপর এক শ্রমিক তাকে সহায়তা করেন বলে জানান।
ভার্মি কম্পোস্টের গুনাগুন জেনে শুনে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা উৎসাহিত হচ্ছেন ভার্মি কম্পোস্ট তৈরিতে। চাটমোহর কৃষি অফিসের অওতায় পনেরো জন ক্ষুদ্র খামারী সম্প্রতি ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি শুরু করেছেন। এদের একজন ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের পাচুরিয়া গ্রামের শরিফুল ইসলাম। পিতার নাম সুলতান মাহমুদ। উচ্চ শিক্ষিত যুবক শরিফুল জানান, প্রফেসর বয়েন উদ্দিন ডিগ্রী কলেজ থেকে বিকম পাশ করে চাকুরির চেষ্টা করছি। বর্তমান বেকার অবস্থায় আছি। একটি প্রিক্যাডেট স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। স্কুলটিও বর্তমানে বন্ধ আছে। তিনি বলেন, “প্রাইভেট পড়ানোর পাশাপাশি প্রথম তিনটি স্যানিটেশন রিং স্লাব পাটের মধ্যে নিজেদের জমিতে প্রয়োগের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির কাজ শুরু করেছি। এক একটি রিং স্লাবে এক পোয়া করে কেঁচো দেয়া আছে। সবজি ও রসুনের খেতে ভার্মি কম্পোষ্ট প্রয়োগ করবো। সব খরচ ও প্রযুক্তি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস দিচ্ছে। সফলতা পেলে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির পরিকল্পনা আছে।”
২০১৩ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে চাটমোহর উপজেলায় অর্থনৈতিক ক্যাটাগড়িতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হন ভাদ্রা গ্রামের মৃত জেহের মোল্লার মেয়ে নূরুন্নাহার বেগম। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখার পর বিভিন্ন কারণে আর সুযোগ হয়নি লেখাপড়া করার। ১৯৮৬ সালে বিয়ে হয়ে যায় তার। বাড়িতে কয়েকটি সেলাই মেশিন আছে। কয়েকজন সেখানে কাজ করেন। এছাড়া গরু মোটা তাজা করণ ও মাছ চাষ করেন তিনি। তার ছেলে এসব কাজে সহায়তা করেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের টেইলারিং প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদনে পরীক্ষামূলক ভাবে কাজ করছেন তিনি। নূরুন্নাহার বলেন, কৃষি অফিসের সিআইজি সমিতির সদস্য আমি। উপজেলা কৃষি অফিস ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে আমাকে উদ্বুদ্ধ করলে অফিসের সহায়তায় গত জুলাই মাসের শেষ দিকে তিনটি সেনেটারী রিং স্লাবে ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদন শুরু করি। আমি নিজের সবজি খেতে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে ভালো ফলন পাচ্ছি। আশা করছি শিঘ্রই বড় আকারে ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদনের কাজ শুরু করবো।”
শরিফুল ও নূরুন্নাহারের মতো আরো ১৩ জন উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় ভার্মি কম্পোষ্ট উৎপাদনের কাজ করছেন। তবে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে এখনও সচেতন হননি চাটমোহরের কৃষকেরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ এলাকার তিন চতুর্থাংশ কৃষক এখনও জানেন না ভার্মি কম্পোস্ট কি। ভার্মি কম্পোস্টের গুনাগুণ সম্পর্কেও তারা সচেতন নন।
এ ব্যাপারে চাটমোহর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহঃ কৃষি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, এসিনা ফোটিডা জাতের লাল কেঁচোর মাধ্যমে গরু মহিষের গোবর, সবজির উচ্ছিষ্টাংশ, আবর্জনা,লতাপাতা, কাগজ, কচুরিপানা এমনকি কলাগাছ থেকেও ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করা যায়। রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে এবং জৈব সার হিসেবে ফসলে ও গাছে এ কম্পোষ্ট ব্যবহার করা যায়। ভার্মি কম্পোষ্টে গাছের প্রয়োজনীয় ১৬টি খাদ্য উপাদান থাকায় তা ফসলের পুষ্টিমান বাড়িয়ে দেয়। এটি মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ফলে জমি পানি কম শোষণ করে। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। মাটির পিএইচ এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ভার্মি কম্পোস্ট এর ভেতর কিছু কোকুন থাকায় এটি মাটিতে কেঁচোর সংখ্যা বৃদ্ধি করে। যেহেতু কেঁচো মাটির অণুজীবগুলোকে কর্মক্ষম করে সেহেতু ভার্মি কম্পোস্ট উদ্ভিদের জন্য উপযোগি। ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে উদ্ভিদে রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাবও কমে যায়। ভার্মি কম্পোস্ট মাটির ভৌত রাসায়নিক ও জৈবিক গুনাগুণ বৃদ্ধি করে।