হাওড়ে আগাম বৃষ্টি আগাম বন্যা: চ্যালেঞ্জের মুখে কৃষক এবং দেশের খাদ্যনিরাপত্তা
কলমাকান্দা, নেত্রকোণা থেকে অর্পণা ঘাগ্রা
“মানুষের উপর আল্লাহর গজব পড়ছে। নইলে এই সময় এত বৃষ্টি, এত বন্যা হওয়ার কথা না। আমার জন্মে এই রহম দিন আমি কোনদিন দেহি নাই। বাইচ্চা থাকলে সামনে আরো কত কি যে দেখমু। জমির ধানগুলা সব শেষ হইয়া গেল। ধানগুলারে বাঁচানোর কোন সুযোগ পাইলাম না।” এমনইভাবে আক্ষেপ করছেন কলমাকান্দা সদর ইউনিয়নের ওমরগাও গ্রামের প্রবীণ কৃষাণী তছিরন বানু (৬২)।
প্রকৃতির এই আকষ্মিক পরিবর্তন অনেক কৃষককে সর্বশান্ত করে দিয়েছে। আকষ্মিক এই দূর্যোগ মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি কারোরই ছিল না এবং প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও কেউ পায়নি। অসহায় কৃষকরা তছিরন বানুর মতো প্রকৃতির এই বিরূপ পরিস্থিতিকে আল্লাহর গজব বলেই মনে করছেন। খারনৈ ইউনিয়নের মেদিরকান্দা গ্রামের কৃষাণী হাসনা আরার প্রায় ৩২ কাঠা ধানের জমি মেদী বিলের পানির নীচে আছে। ধানগুলোতে সবেমাত্র ফুল আসতে শুরু করেছিল। আর মাত্র মাস খানেকের মধ্যে ঘরে নতুন ধান তুলতে পারতেন। ধান ছাড়াও প্রায় ৪ কাঠা জমিতে বিন্দু মরিচ চাষ করেছেন। অন্যান্য বছর প্রতি সপ্তাহে মণপ্রতি ৮০০-১২০০ টাকা দরে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৪-৫মণ মরিচ বিক্রি করেছিল প্রায় ৩-৪ মাস পর্যন্ত। কিন্তু এইবার মাত্র ৫০০ টাকার মরিচ বিক্রি করতে পেরেছে।
এছাড়াও ৪ কাঠা জমিতে বেগুণের চাষ করেছেন। বিগত বছর জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত প্রায় ৮,০০০-১০,০০০ টাকার বেগুন বিক্রি করেছেন। কিন্তু এই বছর এখন পর্যন্ত বিক্রিই করতে পারেনি। অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানির নিচে প্রায় ৯দিন থাকার পর অধিকাংশ বেগুন ও মরিচ গাছ মারা গেছে। তিনি বলেন, “মরিচ ও বেগুণ চাষ বাবদ তাদের ১২,০০০ টাকা খরচ হয়েছে, যা ক্ষতি হয়েছে এবার আর তা পুষিয়ে উঠা সম্ভব হবে না।” তাদের রয়েছে ৬টি গরু ও ৫টি ছাগল। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খাওয়াতে পারছে না। গবাদি পশুর খাদ্য সংকটের কারণে ইতিমধ্যে একটি গরু ২০,০০০ টাকায় বিক্রি করেছেন, অন্য কোন সময়ে সেটি ৪০০০০ টাকায় বিক্রি করতে পারতেন। একইভাবে ৩টি ছাগল ১১,০০০ টাকায় বিক্রি করেছেন অন্য সময়ে সেগুলোও ২৫০০০ টাকায় বিক্রি করতে পারতেন। যে গাভী থেকে প্রতিদিন দেড় কেজি করে দুধ পেতো, সেই গাভী এখন দুধ দেয় না পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ায়। প্রতিদিন এক লিটার দুধ ৬০ টাকা দরে বিক্রি করে ব্র্যাক সংস্থার মাসিক ১৫০০ টাকা কিস্তি পরিশোধ করতো। কিন্তু সেই সুযোগ এখন আর নেই। তিনি বলেন, “অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা হইয়া আমাগরে পথে বসাইয়া দিল।”
খারনৈ ইউনিয়নের ভাসানকুড়া গ্রামটি ভারতীয় সীমান্তের কাছে হওয়ায় হাওর, নদী, খাল, বিলের পানি থেকে নিরাপদে ছিল। কিন্তু অবিরাম প্রায় ১৫ দিনের ভারী বৃষ্টির কারণে কৃষক মুক্তার হোসেনের (৪৫) ১৬ কাঠা জমির তরমুজ গাছ মারা যায় এবং যতটুকু তরমুজ হয়েছে বৃষ্টির পানির নিচে প্রায় ৯-১০দিন থাকার ফলে সব পচে যায়। বর্তমানে তরমুজগুলো বিক্রির পরিবর্তে গরুকে খাওয়াচ্ছে। শত শত অপরিপক্ক তরমুজগুলো জমিতেই অবহেলায় পড়ে আছে খাবার অনুপযুক্ত হয়ে। তিনি বলেন, “আমার স্ত্রী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত। তিন মাস আগে অনেক টাকা খরচ কইরা ময়মনসিংহ ক্লিনিক হতে অপারেশন করাইছি। ডাক্তার আবার যাইতে কইছিল। তরমুজ বিক্রি কইরা টাকা জোগার অইলে আবার ডাক্তারের কাছে নিতাম। কিন্তু এখন চোখে অন্ধকার দেখতাছি। ৮ বছর ধইরা আমি তরমুজ চাষ করি। কখনও তরমুজ চাষ করা বাদ দেবার কথা চিন্তাও করি নাই। কিন্তু এই বছরের অবস্থা দেইখ্যা সামনের বার করার আর সাহস পাইতাছি না। কি যে দিন শুরু অইল। আমার জীবনে এই প্রথমবার এই সময় এই রকম বৃষ্টি অইতে দেখলাম।”
সীমান্তবর্তী সর্বাপেক্ষা উঁচু ও বালি জমিতে ডাটা চাষ করেছেন রংছাতি ইউনিয়নের পাতলাবন গ্রামের কৃষক হুমায়ুন কবীর। বালি জমিতে সবজি টিকিয়ে রাখার জন্য যেখানে তাকে অনেক কষ্ট করে পানি সরবরাহ করতে হয়েছে, সেখানে কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে ৭দিন পানিতে থাকায় ডাটাগুলোর তিন চতুর্থাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি জানান, বিগত বছর তার প্রায় ৩কাঠা বালি জমিতে ডাটা চাষ করে প্রায় ৭,০০০ টাকা আয় করেছিলেন। এইবার বিক্রি শুরু করতেই পারেননি। শ্রম, সময়, টাকা যা বিনিয়োগ করেছেন তার সার্থকতা পেলেন না।
কলমাকান্দা সদর ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামের মৎস্য চাষী রতন মিয়া প্রতিবছরের ন্যায় এই বছরর তার ৪ কাঠা পরিমাণ পুকুরে ৬০,০০০ টাকার মাছ চাষ করেছেন। এ থেকে তিনি আয় করতেন দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকা। আগাম বৃষ্টি ও আগাম বন্যার ফলে মেদী বিলে পানি বৃদ্ধির কারণে এই বছর পুকুরের সবটুকু মাছ চলে গেছে। তিনি বলেন, “প্রতিবছর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আমাদের এলাকায় পানি আসতো। পানি আসার আগেই আমি অন্য পুকুরে মাছগুলো নিয়া যায়তাম। কিন্তু এইবার হঠাৎ কইরা পানি আসাতে মাছগুলা সরাইয়া নিতে পারি নাই। এইরকম পরিস্থিতি আমি কেন- আমার বাপ দাদাও দেখে নাই।”
উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, টানা ভারী বর্ষণের ফলে পাহাড়ি ঢল নামার কারণে ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর এলাকার বাঁধ ভেঙে যায়। এর ফলে কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বড় হাওর, সোনাডুবি হাওর, পেটকি হাওড় ও মহিষাশুড়া হাওড় এবং প্রায় ২০টি গ্রাম, খারনৈ ইউনিয়নের মেদী, চিকনমাটি, তেলেঙ্গা, পিঠাগড়া, খাগড়া, প্রভৃতি বিল এবং প্রায় ১২টি গ্রাম, বরখাপন ইউনিয়নের মেদা বিল (মেদা হাওড়), জাঙ্গিয়া, গোড়াডোবা প্রভৃতি বিল এবং ১২টি গ্রাম, রংছাতি ইউনিয়নের কৃষ্টপুর বিল এবং প্রায় ৬টি গ্রাম, নাজিরপুর ইউনিয়নের পাঁচকাঠা, সিথলী প্রভৃতি বিল এবং প্রায় ১৬টি গ্রাম, লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের লাগাবাদা বিল এবং প্রায় ৬টি গ্রাম, কৈলাটি ইউনিয়নের সালদিষা, ডায়ার, দিলোরা প্রভৃতি বিল এবং প্রায় ২৫টি গ্রাম সহ কিছু কিছু এলাকার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। পানি বাড়লে নিমজ্জিত ফসলী জমির ক্ষতির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ২৮ মার্চ থেকে ০৯ এপ্রিল ২০১৭ সময় কালের মধ্যে মোট ক্ষতিগ্রস্ত ফসলী জমির পরিমাণ ৩,৬৬৫ হেক্টর। নিমজ্জিত ফসলী জমির পরিমাণ ৪,৪৮০ হেক্টর। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ফসলী জমির পরিমাণ ৮১৫ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১৫,২৫০জন।
তবে এখানেই শেষ কথা নয়। বাংলাদেশের মানুষ এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে খাপ-খাইয়ে নেওয়ার এক অদ্ভূত শক্তি, মেধা আর শ্রমের অধিকারী। সারা পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ এবং এ দেশের পেশাজীবী জনগোষ্ঠী। উত্তর পূর্বাঞ্চলের বর্তমান আগাম বন্যার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। এই দূর্যোগময় পরিস্থিতিতে ফসলের জমি রক্ষার জন্য সাময়িকভাবে সংগঠিত হয়েছে ওমরগাও গ্রামের কয়েকজন কৃষক। কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতার প্রত্যাশা না করে অর্ধনিমজ্জিত ফসল রক্ষার জন্য পাইপ দিয়ে পানি সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। রংছাতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাহেরা খাতুন জরুরি ভিত্তিতে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির মিটিং এর মাধ্যমে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ২মাস এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল হক ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং এমপিসহ র্উধ্বতন কর্তৃপক্ষদের পরিদর্শন করাচ্ছেন। অন্যান্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বাঁধ রক্ষার উপকরণ সামগ্রী (বাঁশ, দড়ি) এবং বাঁধ রক্ষাকারীদের খাবার সরবরাহ করছেন। গত ১০ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে উপজেলা পরিষদ হলরুমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক সমন্বয় সভায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যান বিভিন্ন দপ্তরে ও সভায় ক্ষতিকর পরিস্থিতির বিষয় আলোচনা অব্যাহত রাখার বিষয়টি এবং জিআর থেকে চাল ও কিছু বরাদ্দ পাবার বিষয়টি জানিয়েছেন। এর ফলে ৮টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিকে ১ টন ও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নকে ২ টন করে চাল বণ্টন করে দেন। যেন তারা প্রতি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করেন।
কিন্তু এই স্বল্প পরিসরের উদ্যোগ এবং স্থানীয় সাহায্য সহযোগিতা কি এই বড় ধরনের দূর্যোগ মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট? মোটেও নয়। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্যোগ, ত্রাণ এবং পূর্ণবাসন প্রকল্প। যেমন নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুছ বাবুল বলেন, “এই ১-২টন চাল আমরা মাত্র ১০০-২০০ জনকে দিতে পারব। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার অনেক। যাদেরকে দিতে পারবো না তাদেরকে আমরা কি জবাব দিব?” উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “প্রকৃতির নানা রূপ বৈচিত্র্য পরিবর্তনের ফলে এই অসময়ে বৃষ্টিপাত ও বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সুযোগ আমাদের কম। তবে খাদ্য সংকট দুর করার জন্য কৃষকরা বসতভিটেতে ও ভাসমান
পদ্ধতিতে সবজি চাষ বাড়াতে পারে। উঁচু জমিতে আউশ ধানের চাষ বাড়াতে পারে এবং নিবিড় চাষাবাদ করতে পারে যেন সারাবছর খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারে।”
খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওবায়দুল হক বলেন, “কৃষক যখন মাঠে ফসল ফলায় তখন সেই ফসলের উপর শুধু মানুষই নির্ভর করে না আকাশের পশুপাখিও এর উপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির বর্তমান অবস্থার কারণে মানুষসহ সব প্রাণীর খাদ্য উৎসে চরম আঘাট সৃষ্টি হল। যাদের জমি আছে তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাদের নেই তারা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ ভূমিহীন অনেকেই ফসলের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সারাবছরের খোরাক সঞ্চয় করতো। সরকারের উচিত নদীগুলোর গভীরতা বৃদ্ধির জন্য খনন করা এবং পরিকল্পিতভাবে নদীর পাড় বাঁধ দেওয়া।”
উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি চন্দন বিশ্বাস কৃষি বিভাগের কাছে দাবি জানান, যেন পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ (বীজ, সার, সহজ শর্তে ঋণ) সহযোগিতা করেন এবং সরকারিভাবে আপদকালীন বাজেট ও ১০ কেজি চাল বিতরণের ক্ষেত্রে সংখ্যা বর্ধিত করার জন্য প্রস্তাব রাখেন। জেলা পরিষদের সদস্য ইদ্রিস আলী তালুকদার ঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী এনজিওদের কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় না ফেরা পর্যন্ত ঋণের জন্য চাপ না দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। তিনি বলেন, “এই মূহুর্তে ঋণের জন্য চাপ দিলে তাদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া আর কিছু করার থাকবে না।” তাছাড়া দূর্যোগের প্রভাবে এলাকায় চুরি, ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশংকা করে তিনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সচেষ্ট থাকার আহবান জানান। আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে অনেক কৃষক পানি সহনশীল ধান ও সবজি জাত চাষ করতে চান। তাই সরকারের কাছে তাদের দাবি পানি সহনশীল ধান বীজ যেন সহজলভ্য করা হয়।