আগাম বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় কৃষি ফসলের ব্যাপক ফলন বিপর্যয় আশংকা
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
২০১৭ সালকে বৃষ্টির ‘বছর’ বলা যেতেই পারে। এপ্রিল মাস থেকেই এ বছর বর্ষা আরম্ভ হয়েছে (আগাম বৃষ্টি)। এই আগাম বৃষ্টির ফলে গত বোরো ধানের ফলনে ব্যাপক বিপর্যয় হয়েছে। বিশেষভাবে হাওরাঞ্চলের মানুষ আগাম বন্যায় তাদের একমাত্র ফসল বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেনি। ফলে তারা খুবই কষ্টে দিনাতিপাত করছে। যদিও সরকার হাওরাঞ্চলের কৃষক পরিবারগুলোর জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। হাওরাঞ্চলের বাইরের নেত্রকোনা জেলার অন্যান্য এলাকার মানুষ আমন মৌসুমের ধানের জন্য আশায় বুক বেঁধে বীজতলা তৈরি করেন। আগাম বৃষ্টিতে এসব বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরবর্তীতে পুনরায় বীজতলা করে প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে এলাকার কৃষকরা তাদের জমিতে বৈচিত্র্যময় ধানের চারা রোপণ করেন। ধানের জমির আগাছা পরিষ্কার করার পর ধান গাছ বড় হলে অতিবৃষ্টিতে অনেক ধানি জমি পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। আবার অনেক জমির ধান পানিতে আধাআধি ডুবে গেলেও অনেকাংশে টিকে যায়।
তবে উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিগুলোর ধান ফলন ভালো হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া জমিতে কৃষকরা পুনরায় ধানের চারা (নামিলা) রোপণ করে। ধান গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে থাকে, কিন্তু এবারও বাধ সাধে প্রকৃতি। অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার ফলে আমন মৌসুমের ধানি জমিতে মহামারি আকারে রোগবালাই এর আক্রমণ দেখা দেয়। আমন মৌসুমে ধানি জমিতে দেখা দেওয়া রোগ-বালাইয়ের মধ্যে (কৃষি বিভাগের তথ্য ও সরেজমিন মাঠ পরিদর্শন থেকে) সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ (ধানের পাতা আগা থেকে পুড়ে নিচের দিকে বিস্তার হওয়া), ধানের লিফ ব্লাস্ট, গোড়া পচা রোগ ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ উল্লেখযোগ্য। এসব রোগবালাই ধানের থোর ও শীষ বের হওয়ার মূহুর্তে কৃষকরা এর প্রতিকারে তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে পারছেনা। কৃষি বিভাগ ও বিষ বিক্রেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী কৃষকরা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করলেও তেমন কোন উপকার পাচ্ছেন না। ফলে কৃষকরা আমন মৌসুমে ধানের ব্যাপক ফলন বিপর্যয়ের আশংকা করছেন।
বাংলায় একটি প্রবাদ প্রায়ই শোনা যায় ‘মড়ার উপর খড়ার ঘা’। এ প্রবাদটি এ বছর কৃষকদের ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। যেসব জমি অতিবৃষ্টিতেও টিকে ছিল এবং পানিতে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যেসব জমিতে দ্বিতীয়বার ধানের চারা রোপণ করে কৃষকরা কিছুটা হলেও তাদের পারিবারিক খোরাক ঘরে তোলার আশা করছিল গত ২০ ও ২১ অক্টোবর ২০১৭ দু’দিনের নি¤œচাপের ফলে সেসব জমির ফসলও নষ্ট হওয়ার দিকে। ভারী বৃষ্টি ও উল্টা-পাল্টা ঝড়ো হাওয়ার ফলে থোর ও শীষ বের হওয়া ধান গাছ জমিতে জমে থাকা পানিতে হেলে পড়ায় অধিকাংশ জমির ধানের ফলন বিপর্যয় হওয়ার উপক্রম।
অনেক কৃষক আমন ধানের চাষ করে প্রাকৃতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ২০ ও ২১ অক্টোবর এর নি¤œচাপের ফলে সৃষ্ট অতিবৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় সেসব সবজিরও ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কৃষকরা এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। কৃষকরা চড়া মূল্যে টমেটোসহ বিভিন্ন শীতকালীন সবজির বীজ কিনে চারা করলে বীজতলাতেই চারাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। আবার অনেক কৃষক সবেমাত্র বিভিন্ন সবজি (লালশাক, মূলাশাক, ডাটাশাক, পুঁই শাক ইত্যাদি) বাজারে বিক্রি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ অতিবৃষ্টির ফলে সেসব সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বর্তমানে অধিকাংশ কৃষক ঋণ করে পুনরায় সবজি বীজ কিনে বীজতলা করা ছাড়া কোন উপায় দেখছেন না। এক্ষেত্রে তারা কৃষি বিভাগ ও অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে জরুরি ভিত্তিতে সবজি বীজ সহায়তা চেয়েছেন। অন্যদিকে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা বোরো মৌসুমের ধানের বীজ রাখতে না পারায় পুরোপুরি বিএডিসি/বাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা বোরো ধানের বীজতলায় বীজ বপন করে এবং ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে জমিতে ধানের চারা রোপণ করে থাকেন। কিন্তু কৃষকরা অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহেও তাদের প্রয়োজনীয় বীজ বাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারছেন না। কৃষকদের ভাষ্য মতে, বাজারের বীজ আসার সাথে সাথেই বীজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা সময় মতো বীজ না পেলে এবং সঠিক সময়ে জমিতে চারা রোপণ করতে না পারলে আবারও আগাম বন্যায় আগামী বোরো মৌসুমের ধানের ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করছেন।
প্রাকৃতির প্রতিকূল অবহাওয়ায় সবজি ও অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ফলে বাজারে সব ধরনের সবজির উচ্চমূল্য বিরাজ করছে, যা’ অধিকাংশ ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এভাবে প্রকৃতি প্রতিনিয়ত কৃষকদের প্রতিকূলে অবস্থান নিলে কৃষকরা ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়বেন এবং বিঘ্নিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়বেন। তাই এই অবস্থায় কৃষকদের রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের উচিত কৃষকদের পাশে তাদের প্রয়োজনীয় সবজি ফসলের বীজ ও প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট সমস্যার সাথে খাপ খাইয়ে ফসল চাষের কৌশল/প্রযুক্তি (আধুনিক ও লোকায়ত) সহায়তা করা। তা’নাহলে কৃষকরা কৃষি ফসল চাষাবাদে উৎসাহ হারাবে।