নারীবান্ধব সমাজের সংগ্রাম বনাম সামাজিক সহিংসতা

মো. নজরুল ইসলাম: মানিকগঞ্জ
“জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,মাতা ভগ্নি ও বধুদের ত্যাগে হইয়াছে তা মহিয়ান“ মনিষীদের দেয়া এমন অসংখ্য বাণীর সাথে কেউ দ্বিমত করবে না। জগতের অধিকাংশ জনপ্রিয়, পাঠকপ্রিয় বেশির ভাগ উপন্যাস, কবিতা সাহিত্য ও সিনেমার উপজীব্য বিষয় নারীকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে মানুষের মধ্যে মায়া মমতা স্নেহ ভালোবাসা মূলত নারীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। প্রেয়সী ও জননীর প্রতি পুরুষের ভালোবাসা সর্বজনীন। যৌবনের তুঙ্গে, চিরাচরিত দৃশ্যপটে, বার্ধক্যে নারীর সেবা ও ভালোবাসা সকল পুরুষের আকাঙ্কায় নারীই সারথী।
এদিকে জগতের সকল নারীকেই স্থান কাল পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অভিনয় করতেই হয়। তারপরও আমরা নারীকে যখন একজন মানবী হিসেবে দেখি, তখন তাঁর অবস্থা ও অবস্থানের অনেকটাই বিবর্ণ দেখা যায়। যা জায়া ও জননীর পর্যায়ে নয়, যদিও নারী সব সময়ই জায়া ও জননীর ভূমিকা পালন করেন। মানুষ হিসেবে নারীর যে সাধারণ মৌলিক অধিকার, সেটি সমাজ ভেদে ভীষণভাবে উপেক্ষিত থাকে। দেশ-কাল, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ঐতিহাসিকভাবে নারীরা সম্পদ, নিয়ন্ত্রণ,আইনি ও রাষ্ট্রীয়ভাবে চরম বৈষম্যের শিকার। আমাদের দেশে আইনি কিছু সুযোগ রয়েছে, তবে সেটিও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সুরক্ষা পাওয়ার উপায় মাত্র। পারিবারিক আইন থেকে শুরু করে উত্তরাধিকার আইনসহ সকল ক্ষেত্রেই নারীরা সমান অধিকার পেয়েছেন, সেটা আমরা হলফ করে দাবি করতে পারি না এবং সমাজ ও রাষ্ট্রও তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।


জাতিসংঘ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৫-১৯ বছর বয়সী প্রতি ৫ জন কিশোরীর মধ্যে একজন যৌন সহিংসতার শিকার হয়; শতকরা ৮০ ভাগের বেশি বিবাহিত নারী অন্তত একবার সহিংসতার শিকার হন; শতকরা ৭৬ ভাগ নারী উচ্চ শিক্ষাকালীন যৌন হয়রানির শিকার হন এবং শতকরা মাত্র ২.৬ জন নারী শারীরিক ও মানসিক হয়রানির প্রতিকারে আইনি সহায়তা চান। একশন এইড ও জাতীয় নারী নির্যাতন ফোরামের সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ নারী গৃহ সহিংসতার শিকার, যাঁদের ৭২ শতাংশ সহিংসতার বিষয়ে কখনো মুখ খোলেননি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৫৫৪ জন নারী। তাঁদের মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা যান ৩৬৭ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ২০১ জন নারী। সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১ হাজার ৬২৭ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৫৩ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। বেসরকারি সংগঠন বারসিক তার সিংগাইর অঞ্চলে করোনাকালীন সময়ে মাত্র ১০০ জন পরিবারে সাথে বিষয়ভিত্তিক গবেষণায় সংসারে ব্যয় প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতায় স্ত্রী ৪%, স্বামী ৬৩% ও উভয়েই ৩৩% মতামত দিতে পারেন। করোনাকালে নারী নির্যাতনের হার ১০০ জনের মধ্যে হ্যাঁ বলেন ৭৮%, না বলেন ২১% এবং মতামত দেনটি ১% মানুষ।


অন্যদিকে মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি প্রজনন অধিকারের বিষয়টিও উপেক্ষিত। বিয়ে, জন্মনিয়ন্ত্রণ, সন্তানসংখ্যা নির্ধারণে নারীর অধিকার সুরক্ষিত নয়। ‘আমার শরীর আমার আধিকার’ এটি শুধুই একটি স্লোগান। ১৯৯০ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনকে অনেকেই প্রজনন অধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকল্পে মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করেন। নারী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এই সম্মেলনে যুগান্তকারী ঘোষণা দেওয়া হয়। বিয়ে, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নারীর অধিকার। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশসহ মোট ১৩৯টি দেশের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন এবং নিজ নিজ দেশে এই অধিকার বাস্তবাায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার করেন। কায়রো সম্মেলনের ৩০ বছর পরও আমরা দেখি আমাদের দেশে দুই-তৃতীয়াংশ অপ্রাপ্ত বয়সী কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে নিজের অনিচ্ছায়। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কিশোরী সন্তানের জননী হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই। আবার দেশের মোট গর্ভধারণের প্রায় শতকরা ৪০ ভাগই অনিচ্ছাকৃত। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে পুরুষের অংশগ্রহণ মাত্র ১৬ শতাংশ, পক্ষান্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ৮৪ শতাংশ, যদিও পরিবারকল্যাণের দায়িত্ব স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই সমান। অনেক নারী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত শারীরিক অসুবিধা সত্তে¦ও অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ এড়ানোর জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন স্বামীর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারে অনিচ্ছার কারণে। আবার অনেক নারী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্বামীর অনুমতি না থাকায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন না।


বলা বহুল্য যে- ঐতিহাসিকভাবে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী ও পুরুষের ভূমিকা পূর্বনির্ধারিত। পুরুষেরা সংসারের আয় ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত অপরদিকে নারীর ভূমিকা ব্যয় সাশ্রয়ী হলেও সেটি কেবল অন্দরমহলে। এভাবেই আমরা হাজার বছর ধরে মানসিকভাবে বেড়ে উঠেছি। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় আমরা নারী নির্যাতনকেও পরিবারে এবং পরিবারের বাইরে অবলোকন করি কোনো রকম প্রতিতবাদ-প্রতিরোধ না করেই। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পরিবারের সদস্যরা বাল্যকাল থেকে নিজ পরিবারে নারী নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে নির্যাতিত হওয়া এবং নির্যাতন করার প্রবণতা থাকে। সময় এসেছে ভাবার, আমরা এই ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক সহিংসতার অবসান চাই কি না?


বলা হয়,আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং আইনের শাসন নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর জন্য অপরিহার্য হলেও শুধু আইন দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল করা যাচ্ছে না। আইনের পাশাপাশি আমাদের মনোযোগ দিতে হবে সমাজের প্রান্ত থেকে উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পুরুষদের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতীয়মান না করে নারী নির্যাতন রোধকল্পে বিভিন্ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। নারীর অধিকার সুরক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বাল্যবিবাহ এবং যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে পুরুষদের নেতৃত্ব দিতে হবে সম্মুখ থেকে। নারীর প্রতি ঘরে বাইরে সকল প্রকার সামাজিক সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুথবদ্ধভাবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। সংস্থাটি তার কলেবরের মধ্যে মানিকগঞ্জ সদর, সিংগাইর, হরিরামপুর এবং ঘিওর অঞ্চলে নারীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠায় জেন্ডার ন্যায্যতা ও নারীর ক্ষমতায়নকে বেগবান করতে সকল প্রকার সামাজিক ও প্রাকৃতিক সহিংতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক জনসচেতনা কার্যক্রম নিরলসভাবে করে যাচ্ছে।


আমরা জানি, পরিবার এবং জাতি গঠনে নারীদের ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। একজন শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ নারীই পারেন একটি পরিবার গঠনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে। পারিবারিক কলহ, নির্যাতন ও সহিংসতা নারীদের মনোদৈহিক অবস্থায় স্থায়ী বিরূপ প্রভাব ফেলে, যার প্রভাব পড়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর, বিশেষ করে পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। সুসংহত অধিকার না থাকায় নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকেন, যা তাঁদের হীনমন্য করে এবং তাঁদের মানসিক বিষণ্যতার কারণ হয়।


স্বাবলম্বীতার সাথে জড়িয়ে রয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেগম রোকেয়া তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছেন যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমেই নারীর সত্যিকার মুক্তি সম্ভব’। অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন এর ভাষায়, ‘নারী আসলে পুরুষই, পার্থক্য হলো তার অর্থ নাই’ এছাড়াও বিরাজমান সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ নারীকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। ফলে নারী অধিকার, মর্যাদা, সম্পদ ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। নারীর ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নারীর অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না। বাংলাদেশে নারী বিশেষত গ্রামীণ নারী প্রকৃতি থেকেই নিত্যদিনের জীবন-উপকরণ সংগ্রহ করে আসছে। জ্বালানি, পশুখাদ্য, শাক-সবজি, ফলমূল ও ঔষধি গাছ সংগ্রহের জন্য নারী প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় শিকার নারী। ১৯৯৮ এর বন্যা কিংবা ২০০৭ সালের ‘সিডর’এর সময় দেখা গেছে নারী সবচেয়ে বেশি দূষিত পানি ব্যবহার করেছে এবং চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের শিকারও তারা বেশি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানবিক অসহায়ত্বের কারণে নারী আশ্রয়কেন্দ্রে নানারকম হয়রানিরও শিকার হয়েছে। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে নারী আরো দরিদ্র ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লেও বিভিন্নভাবে তাদেরকে উপেক্ষিত করা হচ্ছে।

পরিশেষে আামরা বলতে চাই, নারীবান্ধব ও সামাজিক সহিংসতা মুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ^াসী হয়ে পরিবার ও সমাজ নারীর কাজকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে নয় বরং রাষ্ট্রীয়ভাবেও গৃহকাজসহ নারীর সকল কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশের দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গণনায় গৃহকাজসহ নারীর সবধরনের কাজ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বাস্তবতায় এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে সকল ধরণের কাজে নারীর অভিগম্যতার ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধ পরিহার করতে হবে।

happy wheels 2

Comments