প্রবীণরাই আমাদের শেকড়

নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
‘শত বিপদে মোরা নই দিশাহীন পাশে আছে অভিজ্ঞ প্রবীণ। প্রবীণরাই আমাদের শেকড়। শেকড় যেমন গাছকে শক্তভাবে ধরে রাখে, তেমনি প্রবীণরা তাদের অতীত জীবনের অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা দিয়ে আমাদের জীবনের শত বন্ধুর পথকে, জীবনের পাটাতনকে মসৃণ করে। আমাদের জীবনে চলার পথকে গতিশীল করে সাহস ও প্রেরণা দিয়ে উজ্জীবিত রাখে। বারসিক তার কাজের শুরু থেকেই প্রবীণের জ্ঞানের উপর ভর করে তাদের চিন্তার জগতের উপর নির্ভর করে কাজ শুরু করে। এখনো সকল পেশাবৈচিত্রের প্রবীণ নারী-পুরুষের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, পরামর্শ ও লোকজ চর্চার ভিতর দিয়েই আগামির বাংলাদেশ দেখতে চায় বারসিক। গড়ে তুলতে চায় একটি পারস্পরিক নির্ভরশীল বহুত্ববাদের ন্যায্যতার সমাজ।


বারসিক তাই এখনও খোঁজে ফিরে একজন প্রবীণের প্রত্যাশিত আপন মুখটি। ছুটে যায় তাঁর কাছে জানার জন্য, পরামর্শের জন্য, শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। এবছর তেমনি কয়েকজন শতবর্ষী প্রবীণ মানুষকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে তার কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে বারসিক পরিবার, যা বারসিক বরাবর করে আসছে। যারা সারাজীবন মানুষকে, দেশকে ভালোবেসে উজাড় করে গেছেন জীবন, প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে খাদ্য যোগান দিয়েছেন, জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন, প্রকৃতিকে ভালোবেসে রক্ষা করেছেন প্রাণসম্পদ, সামজিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের অধিকারকে রক্ষা করেছেন।


তেমনই একজন প্রবীণ নেত্রকোনা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকা পাড়া গ্রামের আ: মান্নান তালুকদার (১০৩)। তাঁর পছন্দের বই, একটি শাল উপহার দিয়ে তার প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। আমতলা ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের একতারের নেছাকে (১০৫) পানি গরম করার জন্য ফøাক্স, কলমাকান্দা উপজেলার লেবিং নকরেককে (১১৩) শীতের গরম কাপড়, ও কপসিং নংব্রিইকে (১১৩) গরম কাপড়, এবং টংক আন্দোলন নেত্রী কুমুদিনি হাজংকে (৯৪) গরম কাপড়, গরম পানির জন্য ফ্লাক্স, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত পুরস্কার রাখার জন্য স্যুকেস দিয়ে সম্মান ও ভালো জানানো হয় সম্প্রতি। প্রত্যেকের কাছে তার শতবর্ষী জীবনের গল্প শুনা হয়। গল্পে উঠে এসেছে শৈশব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, প্রকৃতির কথা, পরিবর্তনের কথা, অনেক স্মৃতি বেদনার কথা। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তাদের জীবনের অবদানের কথা তুলে ধরা জরুরি। প্রবীণ আ: মাান্নান বলেন, ‘পৃথিবী বদলাইয়া গেছে, কত কিছু আমাদের চোখের সামনে শেষ হইল, কত জনই মইরা গেল, আর কত কি অইলো।’


তবে আধুনিকতাকে ছুঁতে গিয়ে অন্ধাণুকরণের মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, স্বকীয়তা ভুলে বহুমূখী কর্মব্যস্ততায় প্রিয়জনের দায়বদ্ধতা উপেক্ষা করে ভুল জালের সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছি আমরা। পরিবারকেন্দ্রিক চিন্তার বাইরে গিয়ে পারিবারিক বন্ধনকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করছি। তাতে বয়স বৈষম্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রদ্ধাপ্রাপ্ত অত্যন্ত আপন প্রবীণ মানুষেরা


চরম বাস্তবতার নাম বার্ধক্য। শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের শেষ অধ্যায়ই বার্ধক্য। নিয়মের বেড়াজাল থেকে রেহাই পায়নি ধনী-গরিব, রাজা-বাদশা, উজির-নাজির, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই। জীবন সায়াহ্নে কর্মক্ষম, পরনির্ভরশীলতা, একাকিত্ব, অসহায়ত্ব, দুর্বিষহ, হতাশা, অপ্রাপ্তি, দুশ্চিন্তা, রোগ-শোক, জরা-জীর্ণতা ইত্যাদি এসে বাসা বাঁধে প্রবীণদের মনে। আমরা তাঁদেরকে শ্রদ্ধার আসনে রেখে গড়ে তুলতে চাই আগামির পৃথিবী।

happy wheels 2

Comments