জীবন যখন যেমন
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
ছোট বেলায় বাবার হাত ধরে ভাইদেরসহ একসাথে স্কুলে যেতেন নুরু মিয়া। যে কোনো বড় গাছে ইঠে যেতেন সবার আগে। খোলা মাঠে বন্ধুদের সাথে ঘুড়ি উড়াতে তাঁর জুড়ি ছিলনা একসময়। সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলায় ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই বয়সের ছেলেরা যা যা করে ঠিক সেভাবেই দুরন্তপনা নিয়ে বড় হতে লাগলেন তিনি।
কিন্তু হঠাৎ করে কি যে হলো, একটু দৌড়ালেই পা ব্যথা হয়ে যায়। আর উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি থাকেনা। প্রথমে ভাবলেন এ আর এমন কি। আগের দিন একটু বেশি দৌড়ঝাঁপ হয়ে গেছে হয়তো। তাই একটু ব্যথা করছে। কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।
এভাবেই আস্তে আস্তে পা ব্যথার যন্ত্রণা বাড়তে লাগলো। আগের মতো নুরু আর খেলার মাঠে যেতে পারেনা। খেলার সাথীরা এসে ফিরে যায়। স্কুলেও যাওয়া হয়না প্রতিদিন। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তার কোনো রোগ ধরতে পারেননি। সামান্য ব্যথানাশক ঔষধ দিয়ে বিদায় করে দেন।
ক্রমেই পা’র ব্যথা বেড়ে যেতেই থাকলো। নিরক্ষর ও দরিদ্র মা-বাবা কোনো উপায় না পেয়ে কবিরাজ এর দ্বারস্থ হন। কবিরাজের পানি পড়া, ঝাড়ফুঁক চলে কিছুদিন। এত আরো অবনতি হয়। দু’টি পা এর হাঁটু থেকে নিচের অংশ বেঁকে যায়। সুস্থ মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না।
এই অবস্থায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। কারণ আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে পর্যন্ত ‘প্রতিবন্ধি’ শব্দটি গ্রাম বাংলায় প্রচলিত হয়নি। যারা শারিরীকভাবে দুর্বল থাকতো তাঁদের অবজ্ঞার ছলে বিভিন্ন উপনামে ডাকা হতো। পা এ কোনো সমস্যার কারণে যারা হাঁটতে পারতোনা তাদের ল্যাংড়া বা খোড়া বলা হতো। আর নুরুর ছিল পা’তেই সমস্যা। সোজা হয়ে হাঁটতে পারতেন না। বাড়ির বাইরে গেলেই এসব কথা শুনতে হতো।
এ সকল কথার জন্য সে এক সময় বাড়ি থেকে বের হওয়াই বন্ধ করে দেয়। ফলে অষ্টম শ্রেণির পরে তার আর লেখাপড়া করা হয়নি।
লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। মোটামুটি জমি জমা ছিল একসময়। বাবা মারা যাওয়ার পরে সংসারে অভাব দেখা দেয়। ভাইদের মধ্যে সে তৃতীয়। নিজে অক্ষম থাকয় তার পড়াশুনা হবেনা ভেবেই অন্য ভাইদের পড়াশুনা ছাড়তে দেননি। জমি বিক্রি করে বড় বোনকে বিয়ে দিয়েছেন আর ভাইদের পড়ার খরচ চালিয়ে গেছেন। নিজের ভালোমন্দ কখনো চিন্তা করেননি।
তাঁর ভাইয়েরা এখন প্রতিষ্ঠিত। বড় ভাই ঢাকা শেয়ার মার্কেটে চাকুরি করেন। আর অন্য দুই ভাই প্রাইভেট ব্যাংকে। নুরু বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকেন। বিক্রি করার পরে প্রায় ৫০ শতাংশ জমি ছিল। সেই জমি থেকে যতটুকু ধান পাওয়া যেতো তা দিয়ে দুইজনের খাবার চলতোনা। তাছাড়া ভাইয়েরা নতুন চাকুরি পেয়েছে। বাড়িতে তেমন টাকা পাঠাতে পারেনা।
উপায় না পেয়ে সে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে মুদির দোকানে কাজ নেয়। সেখান থেকে যা পেতো তা দিয়ে সংসারের অন্যান্য চাহিদা পূরণ করতে লাগলো। এই কাজও বেশিদিন করতে পারেনি। চলাফেরা করতে সময় লাগে বলে দোকান মালিক কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়।
এভাবে আরো কিছুদিন যেতে লাগলো। ভাইদের রোজগার বাড়ার পর তারা সংসার খরচের টাকা পাঠাতে শুরু করলো। নুরু তখন চিন্তা করলো ভাইদের কাছ থেকে নিয়ে কতদিন চলবে। নিজেরও তো কিছু করতে হবে। এর মধ্যে তিনি বিয়ে করেছেন। দু’টি ছেলেমেয়ে হয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ আছে।
এই ভেবে তিনি কাজ খুঁজতে লাগলেন। লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে কিছু দোকান ঘর আছে যেখানে নারীরা দোকান চালায়। যেটি ‘মহিলা মার্কেট’ নামে পরিচিত। এখানে কয়েকটি অব্যবহৃত দোকান ঘর রয়েছে। বাজার কমিটির সাথে কথা বলে একটি দোকান তিনি ভাড়া নেন। তারপর সেখানে বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রী ও খেলাধূলার সরঞ্জাম রেখে বিক্রি করা শুরু করে। তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে ইউপি চেয়ারম্যান দোকান ভাড়া মওকুফ করে দেন। কারণ দোকানগুলো ইউনিয়ন পরিষদের তত্বাবধানে পরিচালিত হয়। তাঁর যতদিন ইচ্ছা হয় ততদিন বিনা ভাড়ায় তিনি এখানে দোকান চালিয়ে যেতে পারবেন। অন্যদের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হলেও তাঁকে কোনো ভাড়া দিতে হবেনা।
গত আগস্ট মাস থেকে নুরু অনেক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সকালে খাওয়া সেরে বাজারে চলে আসে। দোকন বন্ধ করে রাতে। যেদিন যেমন বিক্রি হয় তাতেই খুশি থাকে তিনি। বেকার বসে থাকার চেয়ে কাজ করাটাকেই উপযুক্ত মনে করেন নুরু মিয়া।
কারো উপরে বোঝ হয়ে থাকতে চান না তিনি। এখন হয়তোবা ভাইয়েরা সাহায্য করতে চান কিন্তু ভবিষ্যতে এ নিয়ে যে অশান্তি হবে না তার তো কোনো ভরসা নেই। এ কারণেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান তিনি । শারীরিক ভাবে নয়, আর্থিকভাবে। দারিদ্রতার কারণে নিজের চিকিৎসা করা হয়নি, তাই অসুস্থ্যতা নিয়েই বাঁচতে হবে তাকে। কিন্তু বেঁচে থাকারতো একটা অবলম্বন দরকার। সেই অবলম্বনটাই তৈরি করতে চাইছেন।
কারো কাছে হাত পেতে বা সাহায্য নিয়ে নয়, নিজের টাকায় দোকানের জিনিসপত্র কিনেছেন। বাবার মৃত্যুর পর অভিভাবক হয়ে সংসারের হাল ধরেন নুরু মিয়া। সেই সময় থেকে তিল তিল করে জমানো টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন।
এক সময় নিজেকে বড় অবহেলা করতো নুরু মিয়া। মনে করতো ‘আমি সংসারের বোঝা। আমি বেঁচে থাকলেও কোনো কাজে আসবোনা।’ তখন তিনি প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে জানতেন না। এখন জানেন। আর এটাও জানেন তিনি একজন মানুষ। সুস্থ মানুষ যা পারে, তিনিও তা পারবেন। তবে একটু ভিন্নভাবে।
ল²ীগঞ্জ ইউনিয়নের ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের সদস্য তিনি। সরকারি ভাতাও পান। একজন ভাতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে অন্যদের অধিকার পাইয়ে দিতে চেষ্টা করার মানসিকতায় কাজ করার জন্য অঙ্গীকার করেছেন। নিজের অক্ষমতাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে চলার সময়, এখন আর পেছনে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। জীবন যখন যেমন, তখন সেভাবেই চলতে হবে।