সাম্প্রতিক পোস্ট

ছকিল উদ্দিন আজ একজন সফল কৃষক

সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান
একসময় দৈনিক এক টাকা হাজিরার কৃষি শ্রমিক ছিলেন মো. ছকিল উদ্দিন। কৃষি শ্রমিক থেকে তিনি আজ একজন সফল কৃষক। নিজের জমি না থাকলে কৃষি কাজ করা যায় না একথা কখনই বিশ^াস করতেন না তিনি। কৃষি কাজে প্রবল আগ্রহ থাকার কারণে অন্যের জমি লিজ নিয়ে কৃষি কাজ করে কৃষিতে অর্জন করেছেন ব্যাপক সফলতা।
ছকিল উদ্দিন মনে করেন, কৃষি যদি নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে কৃষি কাজ করেও সফলতা অর্জন করা সম্ভব। বর্তমান কৃষি কেবলই উৎপাদনের বিষয় এবং এটি অনেকটা বাজারনির্ভরশীল রাসায়নিক সার বিষের কৃষি। এই বাণিজ্যিক কৃষির বিপরীতে অবস্থান কৃষক করছেন ছকিল উদ্দিন। বর্তমানে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ ,কোম্পানির বীজ সারের ওপর অতিনির্ভরশীলতা, কৃষি শ্রমিকের সংকট, ফসলের লাভজনকনক মূল্য থেকে বঞ্চনাসহ নানান কারণে যখন অনেক কৃষকই কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে যুক্ত হচ্ছেন অন্য পেশায় ঠিক তখনই কৃষি কাজে নিজেকে যুক্ত করেন ছকিল উদ্দিন। জৈব সার ব্যবহার, বীজ সংরক্ষণ, নিজস্ব নিয়ন্ত্রিত বৈচিত্র্যময় কৃষি অনুশীলন করেন তিনি।


সিংগাইর উপজেলাার বলধারা ইউনিয়নের ব্রী কালিয়াকৈর নয়াপাড়া গ্রামে মো. ছকিল উদ্দিন (৬৫) বাস করেন। তাঁর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁর পৈতিৃক নিবাস ছিল সিংগাইর উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের চরজামালপুর গ্রামে। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ছকিল উদ্দিন ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা দিদার আলীও ছিলেন একজন দিনমজুর ও কৃষি শ্রমিক। বসত ভিটায় ২২ শতাংশ জমি ছাড়া আর কোন জমি ছিল না তাদের। সংসারে অস্বচ্ছলতার কারণে চতুর্থ শ্রেণীর বেশি লেখাপড়া করা হয়নি ছকিল উদ্দিনের। সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে আনার জন্য ১৯৬৭ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনিও বাবার সাথে দৈনিক মাত্র এক টাকা হাজিরায় কৃষি দিনমজুরের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৮২ সালে বিয়ে করে ১৯৮৯ সালে জামালপুর থেকে সপরিবারে চলে আসেন সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের ব্রী কালিয়াকৈর নয়াপাড়া গ্রামে। সেখানে এসে শুরু হয় তার জীবনের নতুন সংগ্রাম।


নতুন গ্রামেও অভাব ছিল তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। মাত্র আট শতাংশ জমি নিয়েই তার বসতভিটা। তিন ছেলেসহ মোট পাঁচজনের সংসার ছকিল উদ্দিনের। তার সন্তানদের লেখাপড়া করানোর প্রবল ইচ্ছা থাকলেও অভাবের তারণায় সন্তানদের বেশিদূর পড়াতে পারেননি। তাদের ভরণপোষণের জন্য পরিবারে সদস্যদের নিয়ে দিনে অন্যের জমিতে কৃষি দিন মজুরের পাশাপাশি রাতে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ ধারার পেশার সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। স্থানীয় হাটে বাজারে মাছ বিক্রি করে বিশ হাজার টাকা সঞ্চয়ও করেন। কিন্তু প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট হয়ে যাওযার ফলে মাছ ধরার পেশা থেকে সরে আসতে হয় তাকে।


ছকিল উদ্দিনের পরিবারের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১৪ জন। পরিবারে সদস্য বৃদ্ধির সাথে সাথে চাহিদাও বাড়তে থাকে। সংসারের চাহিদা মেটানোর জন্য ভিন্ন পেশায় নিজেকে যুক্ত করার চিন্তা করেন। বাবার সাথে কৃষি জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করার ফলে কৃষি কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় কৃষি পেশাই বেছে নেন। তিনি মনে মনে ভাবেন কৃষি কাজের মাধ্যমেই তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাবেন। কিন্তু কৃষি কাজের জন্য তার তো নিজের কোন জমি নেই। তবু হাল ছাড়েনি তিনি। মাছ বিক্রি করে সঞ্চয়কৃত বিশ হাজার টাকা দিয়ে গাড়াদিয়া গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেনের দেড় বিঘা কৃষিজমি লিজ নিয়ে শুরু করেন কৃষি কাজ। তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।


নিজস্ব চিন্তা চেতনা থেকে ওই জমিতে তিনি মৌসুমভিত্তিক বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদ শুরু করেন। ছকিল উদ্দিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে তিনি কৃষি থেকে সাত লাখ টাকা আয় করে এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে ১৩ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কৃষিকাজ করছেন এবং ৩৫ শতাংশ জমি ক্রয় করে বাড়ি তৈরি করেছেন। তাঁর চাষকৃত ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, পাট, আলু পেঁয়াজ, দেশী লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ডাবরি। তাছাড়াও গরু, ছাগল, হাঁস ও মুরগি পালনের পাশাপাশি ১০ শতাংশ জমিতে রয়েছে একটি লেবু বাগান। তিনি জানান, ফসলের লাভজনক মূল্যের আশায় মধ্যস্বঃত্ব ভোগীর দৌরাত্ম ছাড়াই ঢাকার কারওযান বাজারে নিজের ফসল নিজেই বিক্রি করেন। এতে করে তিনি উপযুক্ত মূল্য পান। তিনি জানান, প্রতিবছর কৃষি থেকে তার আয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা।


এই প্রসঙ্গে কৃষক ছকিল উদ্দন বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করছি এহন সুখের দেখা পাইছি। আর আমার এই সুখ আইছে কৃষি কামের মাধ্যমে। যত দিন বাইচ্যা আছি কৃষি কাজের সাথেই থাহুম।’ বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে ছকিল উদ্দিন বলেন, ‘সার, বীজ, জমি ভাড়া, কৃষি শ্রমিক সংকট, ফসলের উপযুক্ত দাম না পাওয়া মানুষ এহন আর কৃষি কাম করবার চায় না। তারপরও গ্রামের মানুষ আমাকে দেখে কৃষি কাজে আগ্রহ করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি ও কৃষককে বাচাঁতে কৃষকের একতা তৈরি করতে হবে যেন কৃষক তাদের অধিকার ও মর্যাদা পায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি আগে থেকে কৃষি কাজ শুরু করলেও এই সফলতার পেছনে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র অবদান রয়েছে। এই সংগঠনের সহায়তায় কৃষক সংগঠন তৈরি, জৈব সার, জৈব বালাইনাশক, বীজ সংরক্ষণ, কেচো কম্পোষ্ট তৈরিসহ বৈচিত্রময় ফসল চাষের উপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে আমার অনেক দক্ষতা তৈরি হয় যা আমি কৃষিকাজে অনেক উপকৃত হই।’


অন্যদিকে ব্রী কালিয়াকৈর নয়াপাড়া কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সভাপতি মো. হযরত আলী বলেন, ‘মানুষ যখন কৃষি কাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেখানে কৃষক ছকিল উদ্দিন একজন সফল কৃষক। তাঁর দেখাদেখি অনেক কৃষক কৃষিকাজে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কৃষি কাজের মাধ্যমেই তার সফলতা অর্জন হয়েছে। তার এই সফলতায় তাঁর সামজিক মর্যদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি ব্রী কালিয়াকৈর নয়াপাড়া কৃষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কৃষি উন্নয়ন কমিটির সাথে যুক্ত রয়েছেন।’

happy wheels 2

Comments