নোনার সাথে যুদ্ধ করে ঘর বাঁচালেন সীমা

সাতক্ষীরা, শ্যামনগর থেকে চম্পা মল্লিক।

জীবন বড়ই কঠিন। তাই প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে প্রতিটি প্রাণীকে। নিজের বিবেক, বুদ্ধি, সাহস সবকিছু কাজে লাগিয়ে খুঁজে বের করতে হচ্ছে নিত্যনতুন টিকে থাকার কত শত কৌশল। ঠিক একইভাবে এই সংসার নামক জীবন যুদ্ধে ঘরকে বাঁচাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন উপকূলীয় নারীরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বারবার নদীভাঙন এই এলাকার নতুন ঘটনা নয়। তাই এই পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়ে প্রতিবারই নতুন করে ঘর তৈরি করেন তারা। আর্থিক দিক থেকে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে আবার বারবার নদীভাঙনের ভয়ে অধিকাংশরা ঘরগুলো এখানে মাটি দিয়ে তৈরি করে থাকেন। কিন্তু এই ঘরতো শুধু তৈরি করলেই নয়। প্রয়োজন হয় দীর্ঘস্থায়ী ও সুরক্ষিত করা। মাটির ঘর তৈরির পরে সংকটে আছেন উপকূলীয় নারীরা।

এই প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার সিংহড়তলী গ্রামের নারী, সীমা বিশ্বাস (৪০) বলেন, ‘এখন মাটি এত লবণ হয়ে গেছে যে ঘর বাঁচানো আমাদের জন্য খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে। প্রতিটি মাটির ঘর নোনা ধরতে ধরতে ধ্বসে পড়ছে। একদিন পরপর ঘর, বারান্দা এমনকি উঠানসহ লেপতে (গোবর, মিষ্টি মাটি, বালি ও স্বাদু পানির মিশ্রণের মাটির উপরে এক ধরনের প্রলেপ) হয়। কোন কারণে না লেপতে পারলে নোনার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। গুড়া হয়ে ঝরে পড়তে থাকে ঘরের চারিদিক। এমনকি নদী পাড়ের রাস্তায় ও নোনা ধুলা আর ধুলা। বাতাস আসলে আমাদের আর বাইরে দাঁড়ানো হয় না, দৌড়াতে হয় আড়ালে, বাঁচাতে হয় পোশাক, খাবার প্রভৃতি।’

তিনি জানান, একে অন্যের কাছে কতোনা জানতে চেয়েছেন কোন উপায় আছে কিনা। ফল পাননি কোনটায়। ভাবনা তবুও যায়না মন থেকে। কিছু কিছু বাড়িতে দেখতে পান পলিথিন পেপার ঘরের দেয়ালে ও বারান্দায় পেরেক দিয়ে লাগিয়ে রাখতে। জানতে চাইলেন কয়দিন যায় ভালো। তিনিও প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু তিন থেকে চার দিনের মধ্যে মাটি নোনা ধরে ঝুরঝুরে হয়ে, পলিথিন ও পেরেকসহ পড়ে যায় দেয়াল থেকে। সীমা বিশ্বাস বলেন, ‘তবে ওই দেয়ালের যেটুকু জায়গায় আমি পলিথিন লাগিয়েছিলাম তার পাশের কিছু জায়গা খোলা রাখছিলাম। সেখানে একদিন পরপর যখন লেপতে হতো তখন আমি লেপার সময় পলিথিনের কিছু অংশের উপর দিয়ে ও লেপতাম। যখন মাটি, পেরেক, পলিথিন ঝরে পড়েছিল তখন খেয়াল করেছিলাম লেপা পলিথিনটুকু পড়েনি। আমি তখন ওই পলিথিনটা উঠিয়ে দেখলাম ওই অংশের মাটিটা শেওলা পড়ে গেছে এবং স্যাতসেতে হয়ে আছে। নোনাও ধরেনি। এছাড়া আমরা যখন এই নোনা অংশ লেপি তখন মাটির সাথে বালি মিশিয়ে নেই। অল্প কিছু অংশ কিছুটা ভালো দেখে মনে মনে ঠিক করে নিলাম বারান্দার একটা পাশের সম্পূর্ণ জায়গায় আর একটু ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখবো কেমন হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কয়েকদিন পর আমি বারান্দার একটা পাশের ধূলা প্রথমে ঝেড়ে ফেলি তারপর সম্পূর্ণ জায়গাটা ভিজিয়ে নিই। তারপর মাটির সাথে বালি মিশিয়ে জায়গাটা লেপি। এরপর পলিথিন ভালোভাবে চৌকা করে কেটে নিই এবং ভিজা অবস্থায় দেয়ালে লাগিয়ে দিই। এরপর এর উপর দিয়ে আবার হালকাভাবে বালি মাটি মেশানো জল দিয়ে লেপি। যাতে কাগজটি লেগে থাকে। এরপর থেকে আমি এক সপ্তাহ পরপর লেপি আর অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছি কোন নোনা ধরছেনা। আর এটি অনায়াসে ৫/৬ মাস ভালোভাবে কেটে যাচ্ছে।

মাটির ঘর মাঝে মাঝে লেপতে হয় এটা সবার জানা। তবে কখনো ১/৭ দিন পর পর লেপতে হয়। এটা আমাদের কাছে অনেক সময় ও খাটুনির ব্যাপার। সীমা বিশ্বাস অনেক প্রচেষ্টার ফলে সফল হয়েছেন। তাঁর যেমন কষ্টের দিন কমে গেল, তেমনি চান এই ঘটনাটা অন্য সব লবণাক্ত এলাকার নারীদেরকে জানাতে। যাতে তাদের সময় ও শ্রম দুটোই বাঁচে। লবণ মাটির ঘর সুরক্ষায় যেন তারা স্বস্তি পান।

happy wheels 2

Comments