নতুন করে সাজাতে না সাজাতেই আবার সব হারাতে হয়

সাতক্ষীরার, শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপবেষ্টিত ্গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের বসবাস করেন বিশেষভাবে সক্ষম একজন সংগ্রামী নারী আসমাউল হোসনা আসমা (২৯)। সংসারে ৪ জন সদস্য। স্বামী আব্দুল্লাহ বিয়ের কয়েক বছর যেতে না যেতে তাকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করে সেখানে থাকেন। আর সেখান থেকে তিনি বিভিন্ন জায়গায় যোন- মজুরি দিয়ে বাপের সহায়তায় বাপের বাড়ির পাশে ২ শতক জায়গা কিনে বসবাস করেন। তিনি ছোট বেলা থেকে নানান ঘাত-প্রতিঘাত জলবায়ু পরিবর্তনসহ বৈরী প্রতিকূলতার মাধ্যমে নিজেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।


সম্প্রতি বারসিক’র ধারবাহিক কর্মসূচি জলবায়ু পরিবর্তন ও সক্ষমতা বিষয়ক কর্মশালার মাধ্যমে মাঠ তথ্য সংগ্রহে তার সাথে আলাপ হয়। আসামাউল হোসনা বলেন, “আমি আমার জীবনে প্রথম ৫ বছর বয়সে হারিকেন ঝড় দেখি। সেদিনের কথা আমার কিছুটা মনে আছে। কারণ সে ঝড়ে আমার ও আমার পরিবারের মৃত্যু ঝুঁকি ছিলো বেশি। যেদিন ঝড় হলো সেদিন হঠাৎই দেখি বিলের মধ্যে নাড়া-ধুলা ঘূন্নি দিয়ে পাক খেয়ে আমাদের বাড়ির দিখে আসতে আর সাথে সাথে আমাদের মাটির তৈরির ঘরটা ভেঙে যায়। আর সে ঘরের মধ্যে আমি আমার ছোট বোন ও মা এবং দাদা-দাদি চাপা পড়ি। পরে আব্বা এসে গ্রামের অন্যদের সহায়তা নিয়ে আমাদের উদ্ধার করে। তখন আমার ও মায়ের তেমন সমস্যা না হলে একবছর বয়সী আমার ছোট বোনের মাথায় আঘাত লাগে সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আমরা মনে করেছিলাম সে আর বেঁচে নেই। পরে ডাক্তার দেখানোর পরে ডাক্তার বলে মাথায় চোট পেয়েছে এবং চোখে চোট পেয়েছে। আর সেখানে থেকে তার মাথা ব্যাথা এখনো সারেনি এবং এক চোখে সমস্যা রয়ে গেছে। সেদিন আমাদের ঘর বাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যার জন্য প্রায় এক মাসের বেশি সময় আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে হয়েছিলো। পরে ঘর সংস্কার করে আবার চলে আছি।”


তিনি আরো বলেন, “এই হারিকেন ঝড়ের পাশাপাশি আমার জীবনে সিডর, আইলা, আম্ফান, মহাসেন, বুলবুল ও ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড় দেখেছি। তার মধ্যে সিডরে আমাদের কিছু ফসল নষ্ট হয়েছিলো। আশে পাশের কয়েকজনের মাটির ঘর ভেঙে গিয়েছিলো এবং সেই সময় আমাদের ৩নং ওয়ার্ডের নদী ভেঙে বসতভিটায় লবণ পানি প্রবেশ করে। কিন্তু সব ঝড়ের মধ্যে আইলার কথা কোন দিন ভুলতে পারিনা। এটি আমার মনের মধ্যে দাগ কেটে রেখে গেছে। আমারসহ আমাদের এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ ছিলো অনেক বেশি। আমাদের পুরো গাবুরা ইউনিয়নের প্রায় ১০ জায়গায় ভেঙে যায় এবং ১০ ফুটের মতো পানি বৃদ্ধি পায়। আমি তখন এইচএসসি পরীক্ষার জন্য শ্যামনগরে থাকতাম। আর৩-৪টি পরীক্ষা বাকী আছে। মা আমার পরিক্ষা দেখার জন্য শ্যামনগরে আমার ওখানে ছিলো আর বাবা মধু সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে গিয়েছিলো। বাড়িতে আমার আপা ও তার ১ বছর বয়সী ছেলে ও ছোট বোন ছিলো। বাড়িতে ফোন করে খোঁজ খবর নিচ্ছি যে কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে আমাদের বাড়ির দিকে পানি চলে আসছে।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে কথা বলতে বলতে যখন বেলা ১টা বাজে তখন আর কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিনা। যার কাছে ফোন দিই তার ফোন বন্ধ। কারো ফোনে না পেয়ে মাকে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিই। তখন বর্ষাও হচ্ছে দু’একটি গাড়ি যাচ্ছে কিন্তু কোন গাড়ি দাঁড়াচ্ছে না আমি শ্যামনগরে পাইলট স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি যে বিআরটিসি গাড়ি আসিতেছে কোন হাত না উচু করে সোজা রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাড়ালাম যে গাড়ি তো এবার থামবে আমাকে তো আর চাপা দিবেনা। পরে বিআরটিসিতে করে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত যাই। কলবাড়ি পার হয়ে আর যেতে পারছিনা রাস্তায় পানির স্ত্রোত। গ্রামের দুজন পরিচিত লোকের সাথে দেখা একজন মাছ বিক্রি করতে এসেছিলো কলবাড়িতে আরেকজন শ্যামনগরের বাড়ি থেকে গাবুরায় বাড়িতে যাচ্ছিলো তারা কেউ যেতে পারিনি। তারা আমাকে পরামর্শ দিলো যে শ্যামনগরে চলে যেতে তাদের কথা মতো শ্যামনগরে চলে আসি।”


এ বিষয়ে তিনি আরো জানান, “তার পরের দিন আযান দেওয়ার সাথে সাথে বের হয়ে নীলডুমুর খেয়াঘাট পর্যন্ত গিয়ে দেখি আমাদের পাশের গ্রামের একজন পরিচিত লোক খুবই কান্নাকাটি করছেন। যে তার বাড়ির ১০ জন একসাথে নৌকায় লক্ষ্মীখালী আশ্রয়ন প্রকল্পে যেতে যেয়ে নৌকা ডুবে মারা গেছে। এটি শুনে মনে হলো আমার বড় আপা তার ছেলে, ছোট বোন ও আব্বা কেউ হয়তো বেঁচে নেই। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম একটা নৌকা ঘাটে এসে থামলো। আর সেই নৌকায় আপা তার বাচ্চাকে ও ছোট বোনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আপাকে দেখে চিনতে পারছিনা তার গায়ে শাড়ী গায়ে কাদা মাটি, বাচ্চাটির গায়ে কোন পোশাক নেই আমাকে দেখে কানতে কানতে জড়িয়ে ধরে বললো একটু পানি দে। পানি দেওয়ার পরে আমি শুনতে চাইলাম তোর বাচ্চাকে কিভাবে বাঁচালি তখন বলল ওকে ঘরে যে ককসেট ছিলো তাতে করে ঘরের আড়ার উপরে কিছুক্ষন রেখেছিলাম। তারপরে পানির স্্েরাতের মাত্রা দেখে ককসেট নামিয়ে চাচাদের ঘরের দিকে ¯্রােতে ককসেট ভাসিয়ে দিলাম আর চাচাদের ধরতে বললাম সাথে আমি ও ছোট বোন স্্েরাতের মধ্যে দিয়ে চাচাদের ঘরে যেযে উঠলাম। এভাবে আমরা বেঁচে আছি আর বাপ বেঁচে আছে কিনা বলতে পারছিনা। পরে ওদের নিয়ে শ্যামনগরে চলে আসি। পরের দিন সকালে নীলডুমুর খেয়াঘাটে এসে বসে থাকতাম যে আব্বা ফিরবে কিনা। এভাবে ৪দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেয়াঘাটে বসে থাকতাম অবশেষে ৫ দিনের মাথায় আব্বা ফিরে আসে আব্বাকে নিয়ে শ্যামনগরে চলে আসি।’


তিনি জানান, আইলায় তাদের ভিটার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাড়ি ঘর সব ভেসে গিয়েছিলো। কোন জিনিসপত্র বাঁচাতে পারেননি। একটু পানি কমে গেলে কয়েকদিন পরে বাড়িতে আসলে তিনি বাড়ি চিনতে পারছিলেন না। তাল গাছ দেখে বুঝলেন যে এটি তাদের ভিটা। আইলায় তাদের ঘর বাড়ি, সবজির ক্ষেত, হাঁস-মুরগি, ছাগল, যত রকম আসবাবপত্র সব হারিয়ে ফেলছিলেন।


বর্তমান সময়ের ঝড় সম্পর্কে আসামাউল হোসনা বলেন, “যতই দিন যাচ্ছে ততই ঝড়ের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। আর এর কারণ হলো জলবায় পরিবর্তন। আমাদের দেশে কলখারখান বেশি হচ্ছে, বসত ভিটায় ও সুন্দরবনের গাছ কমে যাচ্ছে, নদী ভাঙন বেশি হচ্ছে, সাথে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে খাল বিল সব জায়গায় যে মিষ্টি পানি ছিলো। আগের দিনে বর্ষাকালে আমরা যখন বিলে খেলা করতাম তখন ঐ পানি আমরা ওখানেই খেতাম। আর এখন বর্ষা হলেও বিল ও খালের পানি মুখে দেওয়া যায় না। আর এই লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে আমাদের নানান ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নারীদের জরায়ু সমস্যা, কৃষি জমি কমে যাওয়া, মানুষ বেকার হয়ে পড়ছে, এলাকায় কাজ কমে যাচ্ছে, সুপেয় পানির সংকট, গবাদী পশু কমে যাচ্ছে, ফলজ গাছ কমে যাচ্ছে, মিষ্টি পানির মাছ হারিয়ে গেছে। এছাড়াও নানান রোগ ব্যাধি হচ্ছে।”


পরিবারের খাবর পানি সংগ্রহ ও ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, “পানি নারী-পুরুষ সবাই সংগ্রহ করে। তবে নারীরা একটু বেশি করে। সেক্ষেত্রে বর্ষাকালে গ্রামের পুকুরে পানি থাকায় এবং মাঝে মধ্যে বর্ষার পানি সংগ্রহ করারয় তখন প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে এবং অন্য সময়ে প্রায় ৪-৫ কিলোমিটার দুর থেকে সংগ্রহ করতে হয়। আর এ পানি কলস, ড্রাম, বোতলে করে সংগ্রহ করি। মাঝে মধ্যে ৩০-৫০ টাকা করে ড্রামে ক্রয় করতে হয়। এছাড়াও লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং সুপেয় পানির সংকট থাকার কারণে নারীরা অনেক সময় গোসল করেনা। পুরুষের যেহেতু জঙ্গলে যায় সেখানে নদীর লবণ পানিতে গোসল করতে পারে। তাই তারা অনেকটা লবন পানি মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমরা নারীরা সব পানিতে গোসল করতে পারিনা। লবণ পানি ব্যবহারের কারণে নানান সমস্যা হওয়াতে লবণ পানি কম ব্যবহার করার চেষ্টা করি।”


পরিশেষে আসমাউল হোসনা জানান, এখানে যেমন লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি ঘূর্ণিঝড় ও বাড়ছে। আর এগুলোকে মানিয়ে নিয়ে আমরা নানান ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। আমরা এখন লবণসহনশীল গাছের চারা লাগাচ্ছি, লবণ পানির মাছের চাষ, বসতভিটা উচুকরণ, বস্তা পদ্ধতিতে সবজি চাষ, ঘরে দড়ি দিয়ে টান বাঁধা, ঘরগুলোতে পিলারের খুটি ও মাটির দেওয়াল না দিয়ে ্এ্যাসবেস্টারের বেড়া দিচ্ছি। এছাড়াও এলাকায় গাছের পরিমাণ কমে যাওয়াতে জ¦ালানি হিসাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের চুলা ব্যবহার করছি। কারণ জ¦ালানী কাঠ পাওয়া গেলে তার মূল্য বেশি এবং বহন কষ্টকর ও ব্যবয়হুল। প্রতিনিয়ত যে দুর্যোগ হচ্ছে এ দুর্যোগে আমরা শুধূ পিছিয়ে যাচ্ছি। আমরা সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি হারিয়ে ফেলছি। কতই বা আর সহ্য করবো। নতুন করে সাজাতে না সাজাতেই আবার সব হারাতে হয়।”


প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ দুর্য়োগের সাথে সংগ্রাম করে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী টিকে থাকার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসমাউল হোসনার মত হাজার হাজার উপকুলীয় জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নানান দুর্যোগের স্বাক্ষী। দুর্যোগে বারবার তাদের সহায় সম্পদ হারাতে হচ্ছে। এর যে শেষ কোথায় তা কেউ বলতে পারছেনা। উপকূলীয় এলাকাগুলো দুর্যোগ সহনশীল করার জন্য সরকারি-বেসরকারীভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। তার জন্য যেমন টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সুন্দরবন সুরক্ষাসহ বিভিন্ন রাস্তায়-প্রতিষ্ঠান ও নদীর চরে এলাকা উপযোগী বনায়ন, অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি চাষ বন্ধসহ আলাদা জোনিং সিষ্টেম করা ইত্যাদি।

happy wheels 2

Comments