ঢাকের তালেই ওদের জীবন চলে

আব্দুর রাজ্জাক ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥

‘ঢাকের তালে কোমর দোলে
খুশীতে নাচে মন,
আজ বাজা কাঁসর জমা আসর
থাকবে মা আর কতক্ষণ’

ঢাকের তালে-তালে গত রোববার থেকে শুরু হয়েছে মন্দিরে-মন্দিরে ভক্তদের দেবী অর্চনা বন্দনা। সারা দেশের মতো ঘিওরেও আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৬৫টি মণ্ডপে পালিত হচ্ছে বাঙালি হিন্দুদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। দেবীদুর্গাকে ভক্তি ভরে বরণ করে নেন সারা দেশের প্রায় পৌনে দুই কোটি হিন্দু নর-নারী। মন্দিরের পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলছে উৎসবের আমেজ। ঢাকের বোল, কাঁসার ঘণ্টা, শাঁখের ধ্বনীতে গতকাল থেকে মুখর হয়ে উঠেছে পূজামণ্ডপগুলো।

দুর্গাপূজার সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের মধ্যে ঢাক-ঢোল অন্যতম। ঢাকের আওয়াজ ব্যতীত দুর্গা দেবীর অর্চনা অসম্ভব। আর নিজেদের তৈরি এ ঢাক-ঢোক নিজেরাই বাজিয়ে সরগরম করার কাজটি প্রায় তিন যুগ ধরে করে আসছেন ঘিওরের বালিয়াখোড়া ও বানিয়াজুরির রাথুরা এলাকার মুনিদাশ পাড়ার শতাধিক ব্যক্তি।

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া গ্রামের মুনিদাশ পাড়াকে সবাই ঢাকঢোল পাড়া হিসেবেই চেনেন। মুনিদাশ পাড়ার সবার ব্যস্ত সময় কাটে ঢাক, ঢোল, ডুগি, তবলা আর কঙ্গ তৈরির কাজে। সেখানে অলস বসে না থেকে ছোট-বড় সবাই কোনো না কোনো কাজ করেন। নারীরাও আছেন সহযোগীর ভূমিকায়। তারা বানান ডুগি-তবলার বিড়া। গৃহস্থালির কাজ শেষে তারা লেগে যান পুরুষদের সাথে। দিন-রাত চলে বিরামহীন কাজ। বসে থাকার কোনো জো নেই। আর পূজা এলে তো কথাই নেই। ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহু গুণ। নাওয়া-খাওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না।

111 (2)

মনিদাশ পাড়ার শতবর্ষী খগেন্দ্র দাশের সাথে কথা বলে জানা যায়, মনিদাশ পাড়ায় ৩৫টি ও বানিয়াজুরির রাথুরার ৫০টি পরিবার এই ঢাকঢোল বানানোর কাজে জড়িত। কেউ পৈতৃক পেশা হিসেবে, আবার কেউ শখ করে এ কাজ করে থাকেন। এখানে ৩০ বছর ধরে এই কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও ঘিওরের বিভিন্ন মুনিদাশ পাড়ায় আরো ২০-২৫টি পরিবার এ কাজের সাথে জড়িত।

মনিদাশ পাড়ার চিত্ত চন্দ্র দাশ (৪৫) বলেন, ‘আমি ২০ বছর ধরে কাজের সাথে জড়িত। এখানে আমরা ঢাক, ঢোল, ডুগি, তবলা, কঙ্গ ও শিশুদের ঢোল তৈরি করে থাকি। এখানে কাঠ ও আকারভেদে বাদ্যযন্ত্রের দাম বিভিন্ন রকমের। তবে একটি ঢাক ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা, তবলা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়ে থাকে। একেকটি যন্ত্র তৈরি করতে ৪-৫ দিন লেগে যায়। ক্রেতারা যেভাবে অর্ডার দেন আমরা সেভাবেই কাজ করে দেই।’ দুর্লভ চন্দ্র দাশ (৪৪) বলেন, ‘আমাদের তৈরি বাদ্যযন্ত্র ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জায়গায় যায়। এ বছর আমরা ঢোলের সবচেয়ে বড় অর্ডার পেয়েছি রামপুরার বাংলাদেশ তাল তরঙ্গ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।’

নারায়ণ দাশ (৭০) নামে এক বয়োবৃদ্ধ ঢোল বাদক বলেন, ‘আমাদের পাড়ার সব পুরুষদের বিভিন্ন মণ্ডপে ঢোল বাজানোর চুক্তি হয়ে গেছে পূজা শুরুর মাসখানেক আগেই। পালাক্রমে দিন-রাত ঢাক বাজানোর কাজে সবাই ব্যস্ত। দিনপ্রতি ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা পেয়ে থাকি।’

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা এমনকি দেশের বাইরেও ঘিওরের মুনিদাশ পাড়ার বাদ্যযন্ত্রের সুনাম আছে। পরিশ্রম বেশি, তবে লাভ খুব একটা না এমনটাই জানালেন ঢাক-ঢোল পাড়ার বাসিন্দারা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়তো শিল্পটি আরো সমৃদ্ধ হবে এমনটিই প্রত্যাশা তাদের।

happy wheels 2

Comments