সব জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পেশার প্রতি সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব দিতে হবে
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
২১ মার্চ আর্ন্তজাতিক জাতিগত বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে ২১ মার্চ দিবসটি পালিত হয়েছে। এ বছর আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বর্ণবাদের বিরুদ্ধে যুবসমাজ’। দেশের অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ন্যায় নেত্রকোনার কাইলাটি ইউনিয়নের কাইলাটি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে গতকাল বারসিক’র সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ‘আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস ২০২২’ উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রবীণ কৃষক জব্বার মিয়ার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিথি কাইলাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহীম খলিল পলাশ। এছাড়াও বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বারসিক’র প্রতিনিধিসহ ৫০ জন অংশগ্রহণ করেন।
আলোচনায় ইব্রাহীম খালিল পলাশ বলেন, ‘আমাদের দেশের সকল সমাজেই বর্ণ বৈষম্য বিরাজ করছে। কোন কোন সমাজে জাতিগত, কোন কোন সমাজে ধর্মীয় বৈষম্য, কোন কোন সমজে বর্ণগত (উঁচু জাত ও নীচু জাত), কোন কোন সমাজে শিক্ষাগত বৈষম্য, আবার কোন কোন সমাজে পেশাগত বৈষম্য বিরাজমান। যে বৈষম্য আমাদের সমাজের সত্যিকারের স্থায়িত্বশীল বা টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে, সমাজের শান্তিকে বিনস্ত করছে। অথচ আমরা কেহই অপরাপর জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পেশার প্রতি নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করতে পারিনা। কারণ আমরা সকলেই কোন না কোনভাবে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল।’ তিনি আরও বলেন, ‘সমাজ তথা দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন করতে হলে সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের লোকদের মধ্যে বৈষম্য না করে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে। সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পেশার প্রতি সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত সকল উন্নয়ন উদ্যোগ বা সেবাসমূহে সকলকে সমান সুযোগ ও সুবিধা দিতে হবে। সকলে যাতে তাদের অধিকার পেতে পারে সেই দৃষ্টিভঙ্গি সকলের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে।’
আলোচনার শুরুতে বারসিক প্রতিনিধি রুখসানা রুমী দিবসটির তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের সমাজে মানুষ বিভিন্নভাবে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হচ্ছে। প্রথমত মানুষ হিসেবে (নারী-পুরুষ), জাতি হিসেবে (বাঙালি, আদিবাসী/উপজাতি/ক্ষুদ্র সৃ-গোষ্ঠী), বর্ণগত ভাবে (শিয়া, সুন্নি, উঁচু জাত, নিচু জাত ইত্যাদি), পেশাগত বৈষম্য (মেথর, মুচি, কামার, কুমার, নাপিত, কৃষক ইত্যাদি), শিক্ষাগত বৈষম্য (শিক্ষিত ও অশিক্ষিত) ইত্যাদি। অথচ আমরা যারা জাতিগত ও বর্ণ বৈষম্যকে বেশি চর্চা করি তারাসহ সকলেই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল, কেউ এককভাবে সমাজে চলতে পারেনা।’ তিনি আরও বলেন, ‘দৈনন্দিন খাদ্যের জন্য তারা যেমন কৃষকের উপর নির্ভররশীল, তেমনি নাপিত, দর্জি, মেথর/মুঠে, কামার ও মুচির উপর কম-বেশি নির্ভরশীল। মোট কথা সকলে সকলের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা ও আন্তঃনির্ভরশীলতার জন্যই আজও আমাদের সমাজ টিকে আছে, আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করছি।’
উল্লেখ্য যে, বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবসের মূল লক্ষ্য হলো-বর্ণের ভিত্তিতে মানুষকে হয়রানি না করা, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা, সমাজের সকল পুরাতন চর্চাগুলো সমূলে বিলোপ করা, যেগুলো সমাজের উন্নয়নে বা বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং সমাজে হানাহানি জিইয়ে রেখে সমাজের শান্তি বিনষ্ট করছে। সমাজ থেকে যেকোন ধরণের বর্ণবাদী মন্তব্য শুরুতেই সমন্বিত উদ্যোগে সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। কেননা সামান্য মন্ত্যব্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার জন্য একসময় অনেক বড় ঘটনার জন্ম দেয়, যা, এক পর্যায়ে জাতীয় পর্যায়ে চলে যায় এবং দেশের সকলের শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়। দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জাতিগত বর্ণবৈষম্যের কারণ এবং এর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পেরে সহকর্মী ও সহপাঠি এবং এলাকার সকলের সাথে সুসম্পর্ক জোড়দার করে পারস্পারিক নির্ভরশীল ও আন্তঃনির্ভরশীলতার শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার করে।