ভূগর্ভস্থ পানি আমাদের একটি গুপ্তধন আসুন এর যত্ন নিই
সিলভানুস লামিন
এক
এবারের পানি দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ভূ-গর্ভস্থ পানি: অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা (‘Groundwater, making the invisible visible)। এর মানেটা হলো, আমরা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে আসছি কিন্তু এই পানির অবস্থা কীরকম আছে, কী অবস্থায় আছে তা আমরা জানি না, যেহেতু এটি দেখা যায় না। আমাদের সচেতনতা, সাশ্রয়ী ব্যবহার এবং পানির অপচয় রোধের মাধ্যমে এ অদৃশ্য ভূ-গর্ভস্থের পানিকে সুরক্ষা করতে পারি। জেনে রাখা ভালো যে, পৃথিবীর মানুষের পান করার জন্য অর্ধেক পানির উৎসই ভূগর্ভস্থ পানি। ৪০% ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয় কৃষিতে সেচ ব্যবস্থার জন্য। অন্যদিকে ৩ ভাগের ১ ভাগ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয় শিল্পখাতে। ভূগর্ভস্থ পানি বাস্তুসংস্থানকে সুরক্ষা দেয়, নদীর তলদেশের পানিপ্রবাহ ঠিক রাখে, ভূমিধ্বস ঠেকায় এবং সমুদ্রের পানিরও ভারসাম্য রক্ষা করে। ভূগর্ভস্থ পানি দেখা যায় না, কিন্তু তার প্রভাব সবখানে দৃশ্যমান। আমাদের পায়ের নিচে অদৃশ্য ভূগর্ভস্থ পানি একটি গুপ্ত ধনের মত, যা আমাদের জীবনকে প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখছে। সত্যি বলতে কী, বিশুদ্ধ পানি বলতেই আসলে ভূগর্ভস্থ পানিকে বোঝায় এখন। দেদারসে, কারণে অকারণে এ সম্পদ নষ্ট করে আসছি। তাই এ সম্পদকে বাঁচানোর জন্য, ফুরিয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য পৃথিবীর মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। ভূগর্ভস্থ এর পানির ওপর চাপ কমানোর জন্য ভূ-পৃষ্ঠের পানি (নদী, খাল, বিল, পুকুর) ব্যবহার বাড়াতে হবে। এজন্য নদী খনন, পুনঃখনন, খাল, বিল, দখলমুক্ত ও দূষণমুক্ত করতে হবে। যা হোক, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত এক প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিবছর ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও’তে এই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সেখানে পানি সম্পদের জন্য একটি বিশেষ দিন ঘোষণার দাবি তোলা হয়। ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই সারাবিশ্বে ২২ মার্চ পানি দিবস পালিত হয়ে আসছে।
দুই
আমাদের দেশে কৃষি উৎপাদনের জন্য ক্রমশ ভূগর্ভস্থের পানির ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫৫ লাখ হেক্টর জমি সেচের আওতায় রয়েছে। শুকনা বোরো মৌসুমে সেচের পানির প্রায় ৭৫ ভাগের উৎস ভূগর্ভস্থ পানি। দেখা যাচ্ছে, সেচের জন্য ১৯৮৫ সালে দেশে নলকূপের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮০০। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ (দৈনিক প্রথম আলো, ২২ মার্চ, ২০২২)। পানির অপচয় রোধ করা না হলে কিংবা ভূগর্ভস্থ এর পানির ওপর বেশি চাপ সৃষ্টি করা হলে আগামীতে বিশ্বের মানুষ চরম পানি সঙ্কটে পতিত হবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ শুস্ক মৌসুমে চরম পানি সঙ্কটে ভুগছে। জানা যায়, বর্তমান বিশ্বে ২.২ বিলিয়ন মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে যারা এ সুপেয় পানিতে প্রবেশাধিকার আছে তারাও নানানভাবে সমস্যাগ্রস্ত। এর কারণ এ সুপেয় পানির অপর্যাপ্ততা। তাদের দৈনন্দিনের পানি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। পৃথিবীর বিশাল পানির মধ্যে মাত্র .০২৫ ভাগ সুপেয়। অথচ নানানভাবে মিষ্টি পানির উৎসগুলোকে দূষিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানি হচ্ছে পৃথিবীর মোট মিষ্টি পানির তিনভাগের এক ভাগ। এই উৎস থেকে আমরা নিত্য প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহার করি। কিন্তু এই উৎস থেকেও পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে। কারণ সেচের জন্য নানানভাবে ভূ-গর্ভস্থের পানি তোলা হচ্ছে। এছাড়া, প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে নানাভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন হচ্ছে। ফলশ্রæতিতে দিনকে দিন পানির সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এ পানি সঙ্কট মোকাবিলায় প্রতিবছরই ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালন করা হয়। দিবস পালনের মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার ও পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো রক্ষা ও সরক্ষণের জন্য নানানভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। ২০২০ সালের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন’। পানির প্রাপ্যতার সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি যোগসূত্র রয়েছে।
তিন
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পানির প্রাপ্যতার একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানান আপদ দেখা দেয়। সেই আপদের মধ্যে খরা, বৃষ্টিপাতহীনতা অন্যতম। বৃষ্টিপাত কম হলে স্বাভাবিকভাবেই ভূগর্ভস্থ ও ভূ-অপরিস্থ পানির ওপর প্রভাব পড়ে। কারণ ন্যুনতম যে পরিমাণ পানি রির্চাজ হওয়ার কথা সেই পরিমাণ পানি রিচার্জ না হয় না। ফলশ্রুতিতে পানির সঙ্কট দেখা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ভূগর্ভস্থ পানিরও সংকট দিন দিন আরো তীব্র হচ্ছে। তাই সকলে মিলে এখনই ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহারে আমাদের কাজ করা অতিব জরুরি। এই পানি দেখা না গেলেও ভূগর্ভস্থ এই পানি সম্পর্কে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। পৃথিবীর শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে ভুগর্ভস্থ পানিই একমাত্র পানির উৎস। কিন্তু পৃথিবীর অনেক জায়গায় দেখা যায়, ভুগর্ভস্থ এই মহামূল্যবান পানিসম্পদ অপচয় করা হয়। আমরা জানিই না ভূগর্ভস্থ পানি আসলে কতটুকু আছে, জলবায়ুতে কি কি ভূমিকা রাখছে! না জেনে আমরা শুধু ব্যবহার করেই যাচ্ছি। অন্যদিকে আমাদের দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছরই পানি সঙ্কট দেখা দেয় কম বৃষ্টিপাত ও খরার কারণে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি আপদ হচ্ছে লবণাক্ততা। নানানভাবে এই লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়ে; বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস হলে সেই লবণাক্ততা মিষ্টি পানির উৎসকে দূষিত করে। ফলে পানির সঙ্কট দেখা দেয়। আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকায় এই সঙ্কটটি দিনকে দিন প্রকটাকারে দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরির্বতনজনিত কারণে কৃষির জন্য, গৃহস্থালী কাজের জন্য, শিল্পকারখানার জন্য এবং মানুষের পানের জন্য আজ সর্বত্রই পানি সঙ্কট অনুভূত হচ্ছে। অথচ বিশ্বব্যাপী বিশুদ্ধ পানির আধারগুলোর দূষণ, দখল এবং ভরাট এখনই হরহামেশাই হচ্ছে! আমাদের দেশে বিভিন্ন এলাকার নদী, খাল, বিল ও জলাভূমি দূষণ ও দখলের চিত্রগুলো প্রতিদিনই পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে বা হচ্ছে। দখল ও দূষণ হচ্ছে প্রায় প্রতিটি নদী। সরকার নদীকে একটি ‘জীবনসত্তা’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পরও আজও পানির উৎস তথা নদী, খালবিল ও জলাভূমির দখল বাণিজ্য কমেনি। তাই তো দেখা যাচ্ছে, শীতলক্ষা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা, সিলেটের সারি, মনু, কিংবা নেত্রকনোর মগড়াসহ দেশের আনাচে কানাচে নদীগুলো দখল ও দূষণ হচ্ছে। এসব নদীর পানিগুলো প্রায়ই ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে রাসায়নিক কৃষি, উপকূলীয় অঞ্চলে অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের কারণে লবণাক্ততা, দেশের অসংখ্য জেলায় আর্সেনিক দূষণ, নদীর তীরবর্তী ও নদী পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ এবং নদীর গর্ভে শিল্পকারখানার বর্জ্যসহ অন্যান্য মানব সৃষ্ট বর্জ্য নিক্ষেপের কারণে আজ বাংলাদেশে পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করছে। এই সঙ্কটটা মার্চ-এপ্রিল মাসে বেশি পরিলক্ষিত হয়। অবশ্য কোন কোন এলাকায় বছরব্যাপীই পানি সঙ্কট দেখা দেয়।
চার
মাটির নিচে পানির আধার সুরক্ষা ও পানির গুণাগুণ বজায় রাখতে ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির সমন্বিত ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ ঘোষিত এ বছরের বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ভূ-গর্ভস্থ অদৃশ্য সম্পদ দৃশ্যমান প্রভাব সামগ্রিক বিবেচনায় তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে পানি সঙ্কটের মূলে পানি সম্পদের বা আধারের স্বল্পতার পাশাপাশি পানির অব্যবস্থাপনাও একটি বড় কারণ। সুপেয় পানি সম্পদের উৎসগুলোকে দূষণ পানি সমস্যা সৃষ্টি করছে। এমনিতেই পানি সম্পদ অপ্রতুল এবং জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে যদি প্রাপ্য পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা না হয় তাহলে পানি সঙ্কট তো দেখা দেবেই। এছাড়া পানি অব্যবস্থানার পাশাপাশি পানির সুষম বণ্টনও একটি সমস্যা যা পানি সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দূষিত পদার্থের প্রকট উপস্থিতির কারণে গভীর নলকূপের পানিও এখন আর নিরাপদ নেই। এতে ঢুকে পড়েছে পানিবাহিত রোগের উপাদান ব্যাকটেরিয়া। সেটাও ভয়াবহ মাত্রায়। সত্তরের দশকের আগে দেশের মানুষের কাছে সুপেয় পানির প্রধান উৎস ছিল ভূপৃষ্ঠ বা পুকুর, নদী-খাল, বৃষ্টি আর জমিয়ে রাখা পানি। সত্তরের দশকের শুরুতে কৃষিকাজের জন্য দেশে প্রথম ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। সেই যে শুরু এরপর আর থামানো যায়নি। ফলে গত চার দশকে দেশে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। যদিও নিরাপদ নয় ভূগর্ভস্থ পানিও। এদিকে উন্নয়নশীল এবং তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরাই সবচে’ বেশি পানি সঙ্কটে ভুগলেও কোকাকোলার মতো বহুজাতিক কোম্পানির পানীয় উৎপাদনের জন্য তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল দেশের পানি সম্পদ ব্যবহার করে। এভাবে দেখা যায়, পানি সঙ্কটের মূলে বৈশ্বিক রাজনীতিও জড়িত। এই বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে পানি ব্যবহারে বিভিন্নভাবে বৈষম্য দেখা দিয়েছে। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ সুপেয় পানি ব্যবহার থেকে বেশি বঞ্চিত। তাই তৃতীয় বিশ্ব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুপেয় পানি সঙ্কট মোকাবিলায় সুপেয় পানির উৎস রক্ষার পাশাপাশি সুষ্ঠু পানিব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। তাই ভূ-উপরিস্থ ও ভূ- ভূ-গর্ভস্থ উভয় পানির উৎসকে রক্ষা করতে হবে। এগুলো আমাদের সম্পদ। আমাদের সম্পদ আমাদেরকেই পরিচর্যা ও যত্ন করতে হবে, বাঁচাতে হবে নিজেকে এবং পৃথিবর সব প্রাণসম্পদকে।