একটি মাটির চুলা, নারীর চর্চা ও পরিবেশ সংরক্ষণ

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
জ্ঞানের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। যতই এর চর্চা হয়, ততই উৎকর্ষতা বাড়ে। আর সেটা যদি নারীর হাত ধরে হয় তবে তো এর পরিধি আরো বিস্তৃত হয়। সৃষ্টিশীলতায় নারীর ভূমিকা অনবদ্য। তাঁরা নিজের মমতা দিয়ে সৃষ্টি করেন, সংরক্ষণ করেন।
দৈনন্দিন জীবনের গেরস্থালীর নানা কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ একজন নারী তাঁর কাজের সুবিধামতো তৈরি করেন। তেমনি একটি উপকরণ হচ্ছে মাটির চুলা। সাধারণত গ্রাম এলাকায় এই চুলা ব্যবহার করে প্রতিদিনের রান্না করা হয়ে থাকে।


নেত্রকোণা এলাকায় এই চুলা বিভিন্ন আকৃতি ও নামের হয়ে থাকে। আলকাটা চুলা, গায়না চুলা, নৌকা চুলা, শিকের চুলা ইত্যাদি। এই সকল চুলার জ¦ালানি উপকরণও ভিন্ন ভিন্ন হয়। কোনোটিতে লাকড়ি, কোনোটিতে খড়, গাছের শুকনো পাতা আবার কোনোটিতে গোবরের ঘুটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভিন্ন ধরণের জ¦ালানি উপকরণ ব্যবহার করে রান্না করার সুবিধাও ভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন গোবরের ঘুটি দিয়ে রান্না করার সময় চুলার পাশে বসে থাকতে হয়না আবার কোনো চুলায় ধোঁয়া কম, তাড়াতাড়ি রান্না করা যায়। নারীগণ তাঁদের দীর্ঘ দিনের চর্চা, জ্ঞানের মাধ্যমে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য অনুসারে চুলার শ্রেণিবিভাগ করেছেন।


লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের সুলতানগাতী গ্রামের নারীরা দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন ধরণের চুলা তৈরী ও ব্যবহার করে আসছেন। শুধু তাই নয় চুলা তৈরির প্রতিযোগিতা, চুলার মেলা, চুলা তৈরির প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা বিনিময় ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমেও তাঁরা নিজেদের তৈরি চুলার সম্প্রসারণ করেছেন বিভিন্ন গ্রামে। যে কারণে নেত্রকোণা অঞ্চলের কান্দাপাড়া, দরুন হাসামপুর, সানকিউড়া ইত্যাদি গ্রামের নারীরা ‘আলকাটা’ নামের চুলা ব্যবহার করছেন।
দরুন হাসামপুর গ্রামের কৃষাণী হোসনা আক্তার ২০১৯ সালে বারসিক’র সহযোগিতায় সুলতানগাতী গ্রামে অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর করেছিলেন। সেখানে তিনি নারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের আলকাটা চুলা (গোলাকার, চারকোণা) তৈরী করা শিখে আসেন। এরপর থেকে তিনি নিজে চুলা তৈরি করে ব্যবহার করছেন। এবং তাঁর প্রতিবেশিদেরকেও এই চুলা তৈরি করে দেয়ার পাশাপাশি অনেককে শিখিয়েছেন। বর্তমানে দরুন হাসামপুর গ্রামের প্রায় ১০/১২ জন নারী আলকাটা চুলা তৈরি করে রান্নার কাজে ব্যবহার করছেন।


এই চুলায় রান্না করার সুবিধা হলো ধোঁয়া কম হয়, লাকড়ি কম লাগে, রান্না হয় তাড়াতাড়ি ও সময় কম লাগে। তাছাড়া রান্নার পাতিল কালো হয়না। তাই পরিষ্কার করতে পরিশ্রম কম হয়।
শীতের শেষ দিকে বিভিন্ন জলাশয়, পুকুরের পানি শুকিয়ে যায়। এই সময় নারীরা মাটি সংগ্রহ করেন। এই মাটি দিয়েই তাঁরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী চুলা তৈরি করেন। এছাড়াও তাঁরা সারাবছর চুলা মেরামত করার জন্য সংগৃহীত মাটি শুকিয়ে সংরক্ষণ করে রাখেন। কারণ শীত মৌসুম ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় পুকুর বা জলাশয়ে পানি থাকে। তাই সে সময় চুলা তৈরি বা মেরামতের জন্য মাটি সংগ্রহ করা যায় না। টেকসই চুলা তৈরির জন্য আঠালো মাটির প্রয়োজন হয়। পুকুর বা জলাশয়ের মাটি আঠালো থাকে। তাই এই মাটি ব্যবহার করে চুলা তৈরি করা হয়ে থাকে।
মাটি সংরক্ষণের পাশাপাশি নারীগণ বিভিন্ন ধরণের জ¦ালানিও সংরক্ষণ করে থাকেন। বর্ষাকালে অনেক সময় জ¦ালানি সংকট দেখা দেয়। কারণ বৃষ্টি হলে লাকড়ি শুকানো যায়না। তাই এই সময়ের জন্য নারীরা বেশি পরিমাণে লাকড়ি শুকিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখেন।


শীতকালে অধিকাংশ গাছের পাতা ঝরে যায়। শুকনো পাতা এই অঞ্চলের একটি অতি পরিচিত জ¦ালানি। বিশেষ করে শীতকালে এই শুকনো পাতা, খড় দিয়ে রান্না করা হয়। এসব জ¦ালানিতে রান্না করার জায়গা বেশি লাগে এবং জায়গা অপরিচ্ছন্ন হয়। তাই এগুলো দিয়ে ঘরের ভেতর রান্না করা যায়না। যে কারণে নারীরা ঘরের বাইরে চুলা তৈরি করেন এবং রান্না করেন। এছাড়া বছরের বাকি সময়ে ঘরেই রান্না করেন।
ধোঁয়ামুক্ত চুলায় রান্না করার ফলে নারীদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়না। এছাড়া ঘরের আসবাব, কাপড়ও ময়লা কম হয়। আবার শুকনো পাতা কুড়িয়ে নিয়ে আসার কারণে বসতবাড়ির আঙিনাও পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে বাড়ির পরিবেশ পরিচ্ছন্ন থাকে।


মাটির চুলা একদিকে যেমন একটি পরিবারের খাবারের চাহিদা পূরণের কাজে লাগে অন্যদিকে পরিবেশের কোনো ক্ষতি করেনা। কারণ মাটি, শুকনো পাতা, খড়, লাকড়ি প্রতিটি পরিবেশের উপাদান এবং এগুলো সংগ্রহ করলে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হয়না। অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক চুলা, গ্যাসের চুলায় রান্না করলে যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হয়ে দূর্ঘটনার ভয় থাকে। কিন্তু মাটির চুলায় এই ধরণের আশংকা থাকেনা। তাছাড়া আধুনিক চুলায় জীবাশ্ম জ¦ালানির (প্রাকৃতিক গ্যাস) প্রয়োজন হয়। যা কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি করে।
একটি মাটির চুলার সাথে নারীর জ্ঞান, চর্চা জড়িয়ে থাকে। তাছাড়া নারীগণ নিজেদের পরিবারের কাজকে সহজ করে সম্পাদন করা, সময় বাঁচিয়ে অন্যান্য কাজে মনোযোগ দেয়ার জন্য বিভিন্ন ধরণের চুলা তৈরি করেন। জ¦ালানি সাশ্রয়, নিজের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার কাজেও তাঁরা ভূমিকা রাখছেন যুগ যুগ ধরে।

happy wheels 2

Comments