একজন আত্মনির্ভরশীল নারী সাফিয়া বেগম
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শিমুল কুমার বিশ্বাস।
উদয় থেকে অস্ত-অবিরাম কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকেন সাফিয়া বেগম। মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের বায়রা গ্রামের এই নারীকে কখনো দেখা যায় সবজির জমিতে, কখনো গরুর খাবারের জন্য ঘাসের বস্তা হাতে মাঠে, আবার কখনো গরুর দুধ, মুরগির ডিম এবং সবজি বিক্রির জন্য বাইমাইল এবং বায়রা বাজারে। এই বৈচিত্র্যময় কাজই স্বামী হারা এই গ্রামীণ নারীকে এনেছে সাফল্য।
এই আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার পেছনে মূখ্য ভুমিকা পালন করেছে তার সংসারের দৈন্যতা বলে সাফিয়া বেগম মনে করেন। সংসারের অনটনের কারণে তৃতীয় নম্বরের মেয়ে সন্তানকে অন্যের কাছে পালক দিতে বাধ্য হয়েছিলেন একদিন। ঘরে কর্মক্ষমতাহীন স্বামী। কিন্তু তিনি ছাড়া সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই! দুই মেয়ে এবং দুই ছেলেসহ ৬
সদস্যর পরিবারের ভার বহন করতে হয় তাকেই।তাই সংসারের চাকা সচল রাখতেই ধীরে ধীরে সাফিয়া বেগম ভিন্নমুখী কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। নিজের সংসার চালানোর জন্য প্রথমে তিনি বাঁশ কিনে চাটাই তৈরির কাজ শুরু করেন। এই চাটাই থেকে প্রতি সপ্তাহে একটি করে চাটাই বিক্রির টাকা রেখে দিতেন মেয়ের বিয়ের গহনা তৈরির
জন্য। কিন্তু এতগুলো মুখের খাবার যোগানোর জন্য এই কাজ যথেষ্ট ছিল না। প্রয়োজনের তাগিদেই এক প্রতিবেশির নিকট থেকে একটি গাভী গরু বাগি (বর্গা) আনেন। প্রথমবারের গাভী যে বাচ্চা দেয় তা তিনি মেয়েকে দিয়ে দেন। অন্যদিকে দুধ বিক্রির টাকা জমিয়ে প্রতিবেশীর নিকট থেকে বাগী নেওয়া গরুটাকে ২৫০০০ টাকা দিয়ে কিনে নেন। শুরু হয় তার সামনের দিকে এগিয়ে চলা। অন্যদিকে স্বামীর সাথে দীর্ঘদিন কৃষি কাজে নিজেকে জড়িত রাখার কারণে কৃষির উপর যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে ফেলেন তিনি। এই দক্ষতার ভিত্তিতেই স্বামীর অসুস্থতার পর তিনি পুরাপুরি কৃষি কাজে সাথে জড়িয়ে পড়েন। তাদের ৪০ শতাংশের জমিতেই শুরু হয় কৃষিতে তার পদচারণা। এই জমিতে তিনি কখনো ধান, কখনো সবজি, কখনো মশলা, কখনো ডাল জাতীয় ফসল নিয়মিত চাষ শুরু করেন তিনি। তার চাষের আওতায় থাকা কৃষি ফসলে মধ্যে রয়েছে বেগুন মরিচ, লাাউ, ডাটা, আলু, পাট শাক, টমেটো, লালশাক, কপি, রসুন, পেঁয়াজ, কালিজিরা, মিষ্টি সোয়াজ, খেসারী, শোলক, মেথি ইত্যাদি। বর্তমানে তিনি নিজে স্থানীয় জাতের বীজ রাখা, জৈব সার তৈরি এবং জৈব বালাইনাশক তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করছেন। যে কারণে কমেছে উৎপাদন খরচ, উৎপাদিত হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার সবজি বাজারে নিতে নিতেই বিক্রি হয়ে যায়।” তাছাড়া তিনি মুরগি পালনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বর্তমানে তার ৪টি মুরগিতে নিয়মিত ডিম দিচ্ছে।
মূলত: এই বৈচিত্র্যময় কাজের মধ্য দিয়ে সাফিয়া বেগম মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন এবং এক ছেলেকে বিদেশ (ওমান) পাঠিয়েছেন। তাছাড়া চলতি বছর শুধুমাত্র দুধ বিক্রি করে বাড়ির বাউন্ডারি দেওয়ার জন্য বিশ হাজার টাকার টিন কিনেছেন এবং ব্যাংকে আট হাজার টাকা সঞ্চয় জমিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। অন্যদিকে ৭ শতাংশের এক চিলতে জমির সঠিক ব্যবহার করে অর্জিত অর্থ এবং ডিম বিক্রির অর্থ দিয়ে পূরণ করেন পরিবারের পোশাক এবং বাড়তি খাবারের চাহিদা। এ সব অর্জন মানসিক শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে কর্মউদ্যোগী এ নারীকে। এখন সাফিয়া বেগমের সংসার চালাতে আর কষ্ট হয় না। একসময় পরিবার তাকে মূল্য দেয়নি, আজ তিনি সেই পরিবারের সিদ্ধান্ত দেওয়ার মানুষ! এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি ছেলের রোজগারের ট্যাকা নিবার চাইনে। আমি কাম (কাজ) করবার পারি।” তাই সমাজে সাফিয়া বেগম এখন আত্মনির্ভরশীল নারী হিসেবে পরিচিত।